আলোকিত ডেস্ক:
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয়। রফতানি আয়ের ৮২ ভাগ আসে এই খাত থেকে। সংকটের মধ্যেও গত ডিসেম্বরে রফতানি আয়ে যে রেকর্ড হয়েছে তার অবদান পোশাক খাতের।কিন্তু পোশাক খাতের প্রাণ শ্রমিকেরা কেমন আছেন? তারা কেমন মজুরি পান? বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজের (বিলস) এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। এমনকি ভারতের চেয়েও অনেক কম। ভারতে পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ হাজার ১৬০ ঢাকা (১২৮ ডলার) আর বাংলাদেশে আট হাজার টাকা (৭৫.৫ ডলার, প্রতি ডলার ১০৬ টাকা হিসেবে)। গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ, গুলিতে একজনের মৃত্যু: বেতন বাড়ানোর দাবিতে গাজীপুরে বিভিন্ন শিল্প কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন একজন শ্রমিক। নিহত শ্রমিকের নাম রাসেল হাওলাদার (২৬)। তিনি বাসন থানার এলাকার ডিজাইন এক্সপ্রেস লিমিটেডের ইলেক্ট্রেশিয়ান ছিলেন। রাসেল ঝালকাঠি সদর উপজেলার খাঘুটিয়া গ্রামের হান্নান হাওলাদারের ছেলে। বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, রাসেলকে মৃত অবস্থায়ই হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তার মরদেহ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। বাসন থানার ওসি আবু সিদ্দিক বলেন, কলম্বিয়া গার্মেন্টের সামনে সংঘর্ষে আহত এক যুবক মারা গেছে বলে শুনেছি। তবে রাসেল কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তা তিনি জানাতে পারেননি। বেতন বাড়ানোর দাবিতে সকালেই রাস্তায় নামেন শ্রমিকরা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা মহানগরীর ভোগড়া এলাকার কলম্বিয়া গামের্ন্টের সামনে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয় বলে জানান বাসন থানার ওসি আবু সিদ্দিক জানান। তিনি বলেন, সকালে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নাওজোড়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের একদিকে মালেকের বাড়ি অন্যদিকে নলজানি এলাকা থেকে বিক্ষোভ নিয়ে শ্রমিকরা চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিক্ষোভ করে। তিন দিক থেকে শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করায় ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহন চলাচল সাময়িক বন্ধ পড়ে বলে জানান তিনি। পরে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করতে করতে বিভিন্ন পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতেও ঢিল ছুড়ে ভাঙচুর করেন। তিনি আরও বলেন, এসময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ভোগরা এলাকার কলম্বিয়া পোশাক কারখানার শ্রমিকরা পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে স্থানীয়রা ও জয়দেবপুর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নিভিয়ে দেয়। গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে রওনা হই। পরে ঘটনাস্থলের যাওয়ার আগেই স্থানীয়রা আগুন নেভায়। সরেজমিনে দেখা যায়, বিক্ষোভের কারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরিবহন যাত্রীরা পড়ে চরম ভোগান্তিতে। ঘটনাস্থল থেকে ঢাকামূখী লেনে দক্ষিণ সালনা পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গাড়ির জট সৃষ্টি হয়। আশুলিয়ায় শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে আহত ২৫: এদিকে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সাভারের আশুলিয়ায় আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষে দুই পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২৫ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। এদের মধ্য চার-পাঁচ জন শ্রমিকের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এদিকে গাজীপুরে শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় গুলিতে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। শ্রমিকদের ভাষ্য, গতকাল সোমবার সকালে তারা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সড়কে নামলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। দফায় দফায় চলা এই সংঘর্ষে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে। সংঘর্ষে আহতরা সাভারের নারী ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানান তারা। নারী ও শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান ডা. জয় ভট্টাচার্য জানান, এ পর্যন্ত সংঘর্ষে আহত ২০-২৫ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে চার-পাঁচ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অবশ্য আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলমের দাবি, শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ রাবার বুলেট ব্যবহার করেনি। সারোয়ার আলম বলেন, ‘আন্দোলনরত শ্রমিকদের ছোড়া ইটে অন্তত দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। শ্রমিকরা খুব উশৃঙ্খল ছিল। শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে জলকামান ও টিয়ারসেল নিক্ষেপ করতে হয়েছে। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কোন দেশে কত মজুরি: বিলসের গবেষণা বলছে, তুরস্কে তৈরি পোশাক খাতে মোট শ্রমিক ৪০ লাখ। শ্রমিকেরা প্রতি ঘন্টায় মজুরি পান ১.৪৮ ডলার। মাসিক ন্যূনতম মজুরি পায় ৩০৭ ডলার। বাংলাদেশি টাকার ২৯ হাজার ১৬৫ টাকা। ভিয়েতনামে কাজ করে ২৫ লাখ শ্রমিক। মাসিক ন্যূনতম মজুরি ১৬৮ ডলার বা ১৫ হাজার ৯৬০ টাকা। ফিলিপাইনে কাজ করে সাড়ে ৫ লাখ শ্রমিক। তাদের ন্যুনতম মাসিক মজুরি ২৪৪ ডলার বা ২৩ হাজার ১৮০ টাকা। মালয়েশিয়ায় কাজ করে দুই লাখ ৬০ হাজার শ্রমিক। মাসিক ন্যূনতম মজুরি ২৭০ ডলার বা ২৫ হাজার ৯৩৫ টাকা। কম্বোডিয়ায় ছয় লাখ শ্রমিক। ন্যূনতম মজুরি ১৯৪ ডলার বা ১৮ হাজার ৪৩০ টাকা। ইন্দোনেশিয়ায় কাজ করে ৪২ লাখ শ্রমিক। ন্যূনতম মজুরি ১৩৭ ডলার বা ১৩ হাজার ১৫ টাকা। ভারতে কাজ করে চার কোটি ৫০ লাখ পোশাক শ্রমিক। ন্যূনতম মজুরি ১২৮ ডলার বা ১২ হাজার ১৬০ টাকা। চীনে শ্রমিক এক কোটি ৫০ লাখ। ন্যূনতম মজুরি ২৬২ ডলার বা ২৪ হাজার ৮৯০ টাকা। বিলসের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক খাতে কাজ করছে ৩২ লাখ শ্রমিক। তারা মাসে ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছে ৭৫.৫ ডলার বা আট হাজার টাকা। বিলসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০২ ডলার বা ২১ হাজার ৪১৫ টাকার করা হচ্ছে। মজুরি বাড়ানোর পেছনে বিলসের যুক্তি কী: বিলস মূল্যস্ফীতি সহ সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নতুন মজুরি প্রস্তাব করছে। তারা দেখিয়েছে ঢাকায় চারজনের একটি শ্রমিক পরিবারে মাসিক খাবার বাবদ খরচ হয় ১৪ হাজার ৩৩০ টাকা, ঘরভাড়া ১০ হাজার টাকা, খাদ্য ও ভাড়া বহির্ভূত ব্যয় সাত হাজার ৪৪৯ টাকা, চিকিৎসা ব্যয় এক হাজার ২৮৭ টাকা, শিক্ষা ব্যয় এক হাজার ২৫৬ টাকা, পোশাকসহ অন্যান্য বয় চার হাজার ৯০৬ টাকা এবং মাসিক সেভিংস এক হাজার ৫৮৯ টাকা। সব মিলে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৩৬৮ টাকা। যেহেতু অধিকাংশ পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুই জনই পোশাক শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন তাই সেহেতু ১.৪৬ জন ফ্যামিলি ইনকাম আর্নার ধরে এক জন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি হয় ২২ হাজার ৮৫৫ টাকা। আর বিলসের গবেষণায় প্রস্তাব করা হয়েছে ২২ হাজার ৮৫০ টাকা। প্রায় একই হারে ঢাকার আশপাশের উপশহর এবং চট্টগ্রামেও মজুরি কাঠামোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলসের পরিচালক (রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট) নাজমা ইয়াসমিন জানান, আমাদের গবেষণার কাজ শেষ হয়েছে। আনুষ্ঠনিকভাবে আমরা ১৫ তারিখের মধ্যে আমাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করব। তার কথা, আমরা গবেষণায় দেখতে পেয়েছি বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি অনেক দেশের চেয়ে কম। প্রতিবেশি দেশের তুলনায়ও কম। তাই আমরা তাদের মজুরি বাড়ানোরও সুপারিশ করছি। মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকরা: বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি তৌহিদুর রহমান বলেন, এখন পোশাক শ্রমিকদের যে ন্যূনতম মজুরি তাতে তাদের মাসের ১০ দিন সংসার চালানোই কঠিন। সংসার চালাতে গিয়ে তারা এনজিওর ঋণের জালে বন্দি হয়ে পড়ছেন। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছেই। টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। অনেকে আগে যারা কষ্ট করে ঘরের জন্য ফ্রিজ বা টেলিভিশন কিনেছেন তা বিক্রি করে দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। কেউ কেউ ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও বিক্রি করে দিচ্ছেন। ঠিকমত খাবার না পেয়ে পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। তিনি জানান, চার বছর আগে পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় আট হাজার টাকা। এখন পাঁচ বছর চলছে। ২ জানুয়ারি আমরা সংবাদ সম্মেলন করে দ্রুত মজুরি বোর্ড গঠন করে ২২ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দাবি জানিয়েছি। মূল বেতন হতে হবে এর ৬৫ শতাংশ। আমরা ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছি। এর মধ্যে এটা করা না হলে আমারা মাঠে আন্দোলন শুরু করব। আমরা আমাদের দাবির কথা লিখিতভাবে সরকার এবং বিজিএমইএকে জানিয়েছি। বিজিএমই সাধ্যের মধ্যে বেতন বাড়াবে: বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, গত চার বছরে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়নি এটা ঠিক নয়। সর্বশেষ মজুরি বোর্ড বেতন বাড়ানোর পর প্রতি বছরই তাদের শতকরা পাঁচ ভাগ হারে ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে। তারা এখন বেতন বাড়ানোর দাবি করছেন। তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। অবশ্যই আমরা মজুরি বাড়াবো। তবে তা আমাদের সক্ষমতার মধ্যে। সবাইকে পরিস্থিতি বুঝতে হবে। তিনি বলেন, পোশাক খাতে গত তিন মাস ধরে অর্ডার কমে যাচ্ছে। ডিসেম্বরে রফতানি আয় বাড়ার কারণ হলো ইউনিট প্রাইস বেড়ে যাওয়া। অর্ডার কিন্তু কমছে। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। তার কথা,পোশাক খাতে আগামী এক বছর নতুন কোনো কর্মসংস্থান হবে না। আমরা চেষ্টা করছি যারা আছেন তাদের ধরে রাখতে। তবে যদি অনেক বেশি বেতনের চাপ দেয়া হয় তাহলে কিন্তু অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে। চলতি বছরে বেশ কিছু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই সব দিক বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্ডার বাড়িয়ে পোশাক খাতকে টিকিয়ে রাখা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ও জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ২০১৫ সালে প্রায় ১২২ শতাংশ বেড়েছিল। সেখানে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার মাত্র ৫১ শতাংশ। এসব বিবেচনায় পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন শ্রমিকরা। মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, মূল্যস্ফীতি ও সুদহার বৃদ্ধির কারণে উন্নত দেশগুলোতে পোশাকের চাহিদা ও বিক্রি কমেছে। এসব বিবেচনায় ১০ হাজার ৪০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী বৈঠকে মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষই সমঝোতায় আসতে সক্ষম হবে বলে তিনি আশা করেন।
আলোকিত প্রতিদিন/ ৩০ অক্টোবর ২৩/ এসবি