আলোকিত ডেস্ক:
বেতন বাড়ানোর দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ। এর মধ্যে মিরপুর, গাজীপুর, সাভারে বিক্ষোভে সহিংসতার ঘটনা গটেছে। গাজীপুরে গত সোমবার একজন নিহত হয়েছেন। মিরপুরে একটি পোশাক কারখানার আন্দোলনরত কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। এতে বেশ কয়েকজন পোশাককর্মী আহত হয়েছে। সাভারের আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে শ্রমিকদের থেমে থেমে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে শ্রমিকদের। এ ঘটনায় দফায় দফায় টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। ফলে আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কসহ দুই পাশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। অন্যদিকে গাজীপুরের সফিপুর এলাকার জেলা ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন উত্তেজিত শ্রমিকরা। এর আগে চন্দ্রা এলাকার আরেকটি ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভাঙচুর করেন শ্রমিকরা। এছাড়া শফিপুর এলাকার তানহা হাসপাতাল নামের একটি প্রাইভেট হাসপাতালেও তারা ভাঙচুর চালান। গতকাল মঙ্গলবার এসব হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে চলমান আন্দোলনের মধ্যেই তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারক (বিজিএমইএ) সমিতির সভাপতি ফারুক হাসান গতকাল বলেছেন, ন্যূনতম মজুরি বোর্ড নভেম্বরের মধ্যেই নতুন বেতনকাঠামো ঘোষণা করবে। সরকার নতুন যে বেতনকাঠামো ঘোষণা করবে, আমরা পোশাক শিল্পের সব উদ্যোক্তা সেটিই মেনে নেবো, শিল্পে যত প্রতিকূলতাই থাকুক না কেন। নতুন মজুরি কাঠামো আগামী ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে।
মিরপুর: রাজধানীর মিরপুরে একটি পোশাক কারখানার আন্দোলনরত কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। এতে বেশ কয়েকজন পোশাককর্মী আহত হন। এরপরই পোশাককর্মীরা পোশাক কারখানায় হামলা চালান এবং গলি থেকে বের হয়ে মূল সড়কে অবস্থান নেন। পরে পুলিশ উভয় পক্ষকে নিবৃত করতে গেলে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে ১৫টি বাস, ২টি মার্কেট, একটি ব্যাংকের শাখা ও ২টি পোশাক কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১২টা থেকে এ সংঘর্ষ শুরু হয় বলে জানা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বেতন বৃদ্ধির দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেশ কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করছে। মিরপুর-১১ তে আজ আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলাকালীন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাস্তায় নামে। পরবর্তী সময়ে তিন পক্ষের মধ্যেই সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পল্লবী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মেজবাহ উদ্দিন বলেন, বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর হামলা হওয়ার পর তারা রাস্তায় নেমে এসেছেন। ডিএমপির মিরপুর বিভাগের পল্লবী জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) নাজমুল বলেন, বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত গার্মেন্টস শ্রমিকদের সঙ্গে প্রথমে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজনের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ও পিকেটিংয়ের ঘটনা ঘটে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশও মাঠে নামে। শ্রমিকরা এখন রাস্তায় আছে, স্থানীয় সংসদ সদস্য এসেছেন বিষয়টি সুরাহা করার জন্য। ইপিলিয়ন কারখানার শ্রমিক চম্পা খাতুনবলেন, সকালে বেতন বাড়ানোর বিষয় নিয়ে ইপিলিয়ন গ্রুপের প্রশাসনের সঙ্গে তাঁরা কথা বলছিলেন। এ সময় তাদের ওপর হামলা হয়। তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন।
সাভার: সাভারের আশুলিয়ায় তৃতীয় দিনের মতো বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে শ্রমিকদের থেমে থেমে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। এ ঘটনায় দফায় দফায় টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। ফলে আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কসহ দুই পাশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বন্ধ রয়েছে সড়কের দুই পাশের সমস্ত দোকানপাট ও শপিংমল। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের আশুলিয়ার ইউনিক, শিমুলতলা, জামগড়া, নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর ও ঘোষবাগ এলাকা ঘুরে দেখা যায় থেমে থেমে বিক্ষোভ করছে শ্রমিকরা। এ ঘটনায় পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ছোড়ে। ফলে সড়কের পাশের সমস্ত দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি থমথমে হওয়ায় দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। ইউনিক এলাকার মাছ ব্যবসায়ী শাহজালাল বলেন, আমরা সকাল-বিকেল দোকান বসাই। গত তিন দিন ধরে সকাল থেকে শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। তাদেরও ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এমন পরিস্থিতিতে দোকানে ক্রেতারা আসে না। ফলে ব্যবসা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি। নরসিংপুর এলাকার চা দোকানি আলমগীর বলেন, তিন দিন ধরে ব্যবসা করতে পারছি না। সকাল হলেই আন্দোলন শুরু করে শ্রমিকরা। ফলে দোকানে ক্রেতা নেই। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশেদুল বারী বলেন, জামগড়া এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে নরসিংহপুর, জিরাবো এলাকার বিভিন্ন কারখানায় হামলা চালিয়েছে শ্রমিকরা। আমাদের টিম সেখানে গিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
গাজীপুর: গাজীপুরের সফিপুর এলাকার জেলা ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন উত্তেজিত শ্রমিকরা। এর আগে চন্দ্রা এলাকার আরেকটি ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভাঙচুর করেন শ্রমিকরা। এছাড়া শফিপুর এলাকার তানহা হাসপাতাল নামের একটি প্রাইভেট হাসপাতালেও তারা ভাঙচুর চালান। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় শফিপুর এলাকার জেলা ট্রাফিক পুলিশের বক্সে হামলা চালিয়ে আগুন দেয় আন্দোলনরত শ্রমিকরা। স্থানীয়রা জানান, গাজীপুরের শফিপুর, মৌচাক ও চন্দ্রা এলাকার আশপাশের শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে টানা সপ্তম দিনের মতো বিক্ষোভ করছেন। বেলা ১১টার দিকে শফিপুরের অবস্থিত গাজীপুর জেলা ট্রাফিক পুলিশ বক্সে ভাঙচুর করে আগুন দেন একদল ক্ষুব্ধ শ্রমিক। এর পরপরই উত্তেজিত শ্রমিকরা চন্দ্রা এলাকায় ট্রাফিক বক্স ভাঙচুর করে। এর আগে শফিপুর এলাকার তানহা হাসপাতাল নামের একটি প্রাইভেট হাসপাতালেও ভাঙচুর করে। গাজীপুরের বাসন থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সিদ্দিক বলেন, শ্রমিকেরা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্নস্থানে অবস্থান নিয়ে মিছিল করছে, ভাঙচুর চালাচ্ছে। আজকে অধিকাংশ কারখানা বন্ধ থাকায় শ্রমিক সংখ্যা কিছুটা কম। তাদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, পোশাক শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে বিপুল পরিমাণ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শ্রমিকদের ভাঙচুর না করে শান্ত থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
বিজিএমইএ সমিতির জরুরি সংবাদ সম্মেলন: তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারক (বিজিএমইএ) সমিতির সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ন্যূনতম মজুরি বোর্ড নভেম্বরের মধ্যেই নতুন বেতনকাঠামো ঘোষণা করবে। সরকার নতুন যে বেতনকাঠামো ঘোষণা করবে, আমরা পোশাক শিল্পের সব উদ্যোক্তা সেটিই মেনে নেবো, শিল্পে যত প্রতিকূলতাই থাকুক না কেন। নতুন মজুরি কাঠামো আগামী ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। গতকাল মঙ্গলবার সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক শিল্পের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান বিজিএমইএ সমিতি। জানা গেছে, নিম্নতম মজুরি বোর্ডে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে ১০ হাজার ৪০০ টাকার মজুরির প্রস্তাব করা হয়েছে। আর শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষে ২৩ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়। আগামীকাল বুধবার আবারও নতুন করে দুই পক্ষ আলাদা আলাদা প্রস্তাব জমা দেবে। নভেম্বরের মধ্যেই বর্ধিত নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ হবে যা কার্যকর হবে ১ ডিসেম্বর থেকে। সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, দেশে ফরেন রিজার্ভে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেই এতসব ঘটনার পরও ধৈর্য্য সহকারে কারখানা চালু রেখেছেন, রাখছেন এবং সব সময়ে কারখানা চালু রাখার প্রত্যয় নিয়ে একনিষ্ঠভাবে পরিশ্রম করছেন। তখন কোনাবাড়ি এলাকায় বিজিএমইএ এর সদস্য প্রতিষ্ঠান এবিএম ফ্যাশন লিমিটেডে অগ্নি সংযোগের ঘটনা মালিকদের সব প্রচেষ্টাকে হতোদ্যম করে দেয়। গত ২৬ তারিখে এবিএম ফ্যাশন লিমিটেড ছুটি দেওয়ার ৩ ঘণ্টা পর বহিরাগত কিছু সন্ত্রাসী কারখানা ভাঙচুর করে। গতকাল দুপুর ১২টায় কারখানা ছুটি দেওয়ার পর কিছু বহিরাগত সন্ত্রাসী হাতুড়ি, শাবল দিয়ে প্রধান ফটক ভেঙে বেতরে প্রবেশ করে কর্মকর্তাদের জিম্মি করে প্রায় ২ ঘণ্টা তাণ্ডব চালায় এবং কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে করে আগুনের ধোয়াঁয় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে কারখানার বাটন অপারেটর মো. ইমরান মারা যান। তিনি বলেন, এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মালিকদের জানাতে চাই, দেশ ও শিল্পের স্বার্থে, শ্রমিক ভাইবোনদের কর্মসংস্থান সুরক্ষিত রাখতে, যদি কোনো কারখানায় শ্রমিক ভাইবোনেরা কাজ না করেন, কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে যান, তবে মালিকরা ১৩ (১) ধারায় কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন। আজকের এ প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর প্রতি অনুরোধ, পোশাক কারখানাসহ সব ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তা প্রদান করুন, এলাকায় সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করুন, সর্বোপরি জানমালের নিরাপত্তায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। তবে এতে করে কোনো প্রিয় শ্রমিক ভাইবোন বা কর্মচারী এবং মালিক যেন কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে সতর্ক থেকে কাজ করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আমরা সম্পূর্ণরূপে ওয়াকিবহাল আছি বর্তমানে আন্তর্জাতিক কারণে স্থানীয় পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আমাদের শ্রমিক ভাইবোনেরা কতখানি কষ্টে আছেন। তাদের এ কষ্টে আমরা প্রতিটি উদ্যোক্তা সমব্যাথী। সে সঙ্গে এটিও উপলব্ধি করেছি, শিল্প যত সমস্যাতেই থাকুক না কেন, পোশাক পরিবারের সদস্য, প্রতিটি শ্রমিক ভাইবোনদের সাধ্য অনুযায়ী ভালো রাখা আমাদের উদ্যোক্তাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এসময় তিনি বলেন, আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, যখন নূন্যতম মজুরি কাজ করছে, নভেম্বরের মধ্যেই নতুন বেতনকাঠামো ঘোষিত হতে চলেছে, তখন আমাদের শান্ত ও নিরীহ শ্রমিক গোষ্ঠীকে উসকানি দিয়ে অশান্ত করা হচ্ছে, যদিও নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার আগে আন্দোলন করার যৌক্তিকতা নেই। যেখানে নূন্যতম মজুরি বোর্ড কাজ করছে এবং যে বোর্ডে শ্রমিক পক্ষ ও মালিক পক্ষ প্রতিনিধি এবং নিরপেক্ষ সদস্য রয়েছেন। অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, গত কয়েকদিন ধরে বহিরাগতদের উসকানিতে কিছু পোশাক কারখানায় শ্রমিক ভাইবোনেরা কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন, কারখানা ভাঙচুর করছেন। ফলশ্রুতিতে অনেক উদ্যোক্তা বাধ্য হচ্ছেন, কারখানা বন্ধ করে দিতে, যা একান্তভাবে অনভিপ্রেত। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, বহিরাগতদের উসকানির কারণে পোশাক কারখানার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু লেদার কারখানা, ক্যামিকেলের গোডাউন, ফ্যাব্রিক্স এর গোডাউন, দোকানপাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আলোকিত প্রতিদিন/ ৩১ অক্টোবর ২৩/ এসবি