বাড়তি পরিবহন ব্যয়ের প্রভাব নিত্যপণ্যে

0
568

আলোকিত ডেস্ক:

গার্মেন্টস কর্মী রাহেলার মনে শান্তি নেই। বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধের মুখে তাকে প্রতিদিন আগুন আতঙ্ক নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়। এত ঝামেলার মধ্যে আবার বেড়ে গেছে ভোগ্যপণ্যের দাম। বেতনের টাকায় এখন যেন আর কুলায় না! অবরোধের কারণে বেড়ে গেছে জিনিসপত্রের দাম। ফলে রাহেলাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শিল্প মালিকরা। কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক ভাড়া তিন থেকে চারগুণ বেড়ে গেছে। আড়ত মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুলিশী পাহারায় কিছু পণ্যসামগ্রী এলেও পরিবহন ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত দু’সপ্তায় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে শ্যামবাজার কৃষিপণ্য বণিক সমিতির সভাপতি হাজী মো. সাঈদ বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে পণ্য সরবরাহ কমে গেছে। নৌপথে কিছু পণ্য এলেও সড়কপথে পণ্য সেভাবে আসছে না। ৫০ হাজার টাকার ট্রাক ভাড়া বেড়ে এখন ১ থেকে দেড় লাখ টাকা হয়েছে। এ কারণে বাজারে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। পেঁয়াজের পাশাপাশি গত সপ্তায় সয়াবিন তেল, পামওয়েল, সুপার পাম, ডাল, মুরগি, মাংস, আলু এমনকি আদা ও রসুনের দামও বেড়ে গেছে। চালের দাম কেজিতে বাড়ছে ৫ টাকা করে। তবে হরতাল-অবরোধ চলতে থাকলে আগামী সপ্তায় চালের দাম বাড়ার আভাস দিয়েছেন কাপ্তানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, উত্তরবঙ্গ বিশেষ করে রাজশাহী থেকে চালের সরবরাহ কমে গেছে। হরতাল-অবরোধে পিকেটাররা পণ্যবাহী ট্রাকে অগ্নিসংযোগসহ ভাংচুর করছে। এ কারণে ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না। আর দু’একটি এলেও ভাড়া দিতে হচ্ছে তিন থেকে চারগুণ। এদিকে সবজির বাজারেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। শীতের সবজির মৌসুমে কৃষকরা সরবরাহজনিত কারণে ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। কিন্তু নগরবাসীকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। মহাসড়কে পণ্য সরবরাহকারী যানবাহন চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষকের ক্ষতির পাশাপাশি বাড়ছে নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম। দেশের পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী নেতা হাজী মো. আলী ভুট্টো বলেন, সড়কপথে না এলেও নদীপথে কিছু পণ্য সরবরাহ হচ্ছে। ফলে চাহিদামতো পণ্য সরবরাহ না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এছাড়া প্রতিটি হরতাল-অবরোধে কেবল পরিবহন খাতেই প্রায় পৌনে এক কোটি মানুষ আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। কাপ্তান বাজারের জামশেদ স্টোরের ম্যানেজার আবদুল গনি বলেন, আমরা হরতাল-অবরোধ চাই না। আমরা ব্যবসাবান্ধব বাংলাদেশ চাই। হরতালের কারণে আমরা কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছি না। তাই বিএনপির কাছে আমাদের অনুরোধ আপনারা হরতাল-অবরোধ পরিহার করুন, বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচি দিন। একদিকে বেকার হয়ে যাওয়া ও অন্যদিকে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। সহিংস ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় হরতাল-অবরোধের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে নগরীর স্বল্প আয়ের মানুষের। সহিংস ও হিংস্র রাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের চরম ঘৃণার সৃষ্টি হচ্ছে। উদ্যোক্তারা মনে করছেন, হরতাল ও অবরোধের কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়বে, ঘটবে মূল্যস্ফীতি এবং কমে আসবে কর্মসংস্থান। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম জানিয়েছেন, হরতাল-অবরোধের কারণে স্বল্প আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়ে। বিশেষ করে দিনমজুর, সিএনজি, রিকশা ও ঠেলাগাড়ি চালকরা বেকার হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদে এভাবে হরতাল চলতে থাকলে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক অবক্ষয়ের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি নির্ধারণ করা উচিত। কাপ্তান বাজারের ক্রেতা লালন বলেন, বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধের কারণে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের কর্মসূচি বন্ধে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বেনাপোল থেকে পণ্যবাহী ট্রাকে ভাড়া বেড়েছে:বিএনপির ডাকা চলমান অবরোধে বেনাপোল থেকে ট্রাক ভাড়া অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে রাজধানী ঢাকায় ট্রাক ভাড়া ছিল ১৮ হাজার টাকা, সেখানে এখন নেয়া হচ্ছে ২৫-২৬ হাজার টাকা। যে কারণে আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এখন আমদানি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ পণ্যবাহী ট্রাকে, যা স্বাভাবিক সময়ে হয়ে থাকে সাড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ ট্রাক। হঠাৎ ভাড়া বাড়ার কারণে ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন আমদানিকারক, পরিবহন এজেন্ট ও সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীরা। ঢাকার আমদানিকারক প্যাকস্টন লিমিটেডের প্রতিনিধি ফারুক আহমেদ জানান, অবরোধের কারণে বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসতে ট্রাক ভাড়া বেড়েছে ৭-৮ হাজার টাকা। এতে করে আমাদের ব্যয় বাড়ছে। নারায়ণগঞ্জের আইডিয়াল ফাইবার লিমিটিডের প্রতিনিধি শাহ আলম বলেন, একে তো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নেই। তারপর এখন বেড়েছে ট্রাক ভাড়া। প্রতি ট্রাক প্রতি বেশি নেয়া হচ্ছে ৭-৮ হাজার টাকা। আবার সরকার রাজস্বও বাড়িয়েছে। এতে করে ব্যবসায়ীরা নানামুখী সমস্যায় পড়েছে। ঢাকার নবাবপুরের তালুকদার ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠানের আমদানিকারক ইকবাল আহমেদ জানান, তার ব্যবসার কেমিক্যাল ভারত থেকে আসে। তার কয়েকটি পণ্যের চালান গত ৩১ সেপ্টেম্বর বেনাপোল বন্দরে এসেছে। বন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতাও শেষ করেছেন। কিন্তু ট্রাক ভাড়া করতে গেলে ভাড়া এক লাফে ৮ হাজার টাকা বেশি জানায়। অতিরিক্ত ট্রাক ভাড়ার কারণে তিনি পণ্য বেনাপোল বন্দর থেকে ফ্যাক্টরিতে নিতে পারছেন না। বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজিম উদ্দিন গাজী বলেন, অবরোধের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর করা হচ্ছে। এতে করে মালিকরা ট্রাক রাস্তায় নামাতে চাইছেনা। আবার চালকরাও গাড়ি চালাতে অসম্মতি জানাচ্ছেন। এতে করে বেনাপোল বন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য পরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি আতিকুজ্জামান সনি বলেন, আগে বেনাপোল থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহনে প্রতি ট্রাকের ভাড়া ছিল সর্বনিম্ন ১৭-১৮ হাজার টাকা। একই ট্রাকের ভাড়া এখন বেড়ে হয়েছে ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা। একইভাবে কাভার্ডভ্যানের ভাড়া ২৫ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এত বেশি ভাড়া দেওয়া সত্ত্বেও খালি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বেনাপোল বন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য পরিবহন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন, পরিবহন সংকটের জন্য ট্রাক ভাড়া এখন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কাচাপণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে পণ্য খালাস করে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুর রহমান বলেন, অবরোধের কারণে বেনাপোল থেকে ট্রাক ভাড়া বেড়েছে। প্রতি ট্রাকে কমপক্ষে ৭-৮ হাজার টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। বেনাপোল বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) রেজাউল করিম বলেন, বিরোধীদলের ডাকা অবরোধেও বেনাপোল বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে স্বাভাবিক সময়ে আমাদের এখান থেকে প্রতিদিন আমদানি হয়ে থাকে গড়ে ৪০০ ট্রাক। খালাস হয় সাড়ে ৩০০-৪০০ ট্রাক। সেই তুলনায় আমদানি ও খালাস কম হচ্ছে। এদিকে বেনাপোল শুল্ক ভবনের যুগ্ম কমিশনার মো. শাফায়েত হোসেন বলেন, বেনাপোল কাস্টমস হাউসে শুল্কায়নের কাজ যথানিয়মে চলেছে। আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে।

আলোকিত প্রতিদিন/ ৬ নভেম্বর ২৩/ এসবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here