আলোকিত ডেস্ক:
ঢাকায় যাত্রীদের জিম্মি করে দুই থেকে তিনগুণ ভাড়া আদায় করছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকরা। মিটার দৃশ্যমান থাকলেও প্রায় শতভাগ সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক মিটারে যেতে চান না। রাস্তায় এই মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে চালক ও মালিক একে অপরকে দুষছেন। মাঝখানে পথে পথে ভাড়ার পেছনে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে তাদের সুবিধা দেখার কেউ নেই। যাত্রীদের কাছ থেকে এভাবে মাসের পর মাস অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সড়ক আইনে অস্পষ্টতায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। আর অটোরিকশা শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, ২০১৫ সালের পর পাঁচবার গ্যাসের দাম বাড়লেও ভাড়া সমন্বয় করা হয়নি। ফলে খেসারত দিতে হচ্ছে সবাইকেই। মহাখালী থেকে নয়াবাজার যেতে ভাড়া হাঁকা হচ্ছে ৫০০ টাকা। যাত্রী দিতে চান ২৫০। চালক নারাজ। অবশেষে আরও কয়েকটি অটোরিকশা ঘুরে শেষমেশ ৩০০ টাকায় রফা। এরকম নিরুপায় হয়ে অনেকেই বাড়তি ভাড়ায় যাতায়াত করেন সিএনজিতে। গণপরিবহনে নিত্য নৈরাজ্যের এই শহরে সিএনজি অটোরিকশায় এখন আর মিটার বলে কিছু নেই। ইচ্ছে মতো ভাড়া হাঁকিয়ে রীতিমতো জব্দ করা হচ্ছে যাত্রীদের। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদেরকেও আজকাল মিটার নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যায় না। ফলে অনিয়মই যেন পরিণত হয়েছে নিয়মে। সিএনজি অটোরিকশা মিটার অনুযায়ী ভাড়া আদায়ে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিলো সবশেষ ২০১৫ সালে। কিন্তু, তার কয়েক সপ্তাহ পর থেকে সবাই যেন ভুলে গেছে সব। আর, চালকদের যথারীতি একই অভিযোগ- ‘জমা বেশি’। সঙ্গে যোগ হয়েছে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য। বিআরটিএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি সিএনজি অটোরিকশায় মালিকের জমা ৯০০ টাকা। কিন্তু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেয়া হচ্ছে ১২ থেকে ১৩শ টাকা । সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির সিনিয়র সহ সভাপতি আব্দুল খালেক মজনু বলেন, সরকার যদি বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভাড়া পুনঃ নির্ধারণ এবং সমন্বয় করতো তবে অবশ্যই চালকরা ঢাকার বৈধ গাড়ি মিটারে চালাতে পারতো। সেই সঙ্গে মালিকরাও সরকার নির্ধারিত জমা নিতে পারতো। আজিমপুর থেকে বনানী যাবেন আবু জাহির। একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার জন্য ছয়জন চালকের সঙ্গে দরকষাকষি করেন তিনি। তাদের কেউই মিটারে যেতে রাজি নন। আবু জাহিরের গন্তব্যের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। যেখানে মিটারে ভাড়া সর্বোচ্চ ১৩০ টাকা আসার কথা। চালকরা সেই দূরত্বে ভাড়া দাবি করেন ৩০০ টাকা। পরে বাধ্য হয়েই তিনি ২৬০ টাকায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছান। শাহবাগ মোড় থেকে যাত্রাবাড়ী শহিদ ফারুক রোডে যাবেন ব্যবসায়ী আজিজুল ইসলাম। তার যাত্রাপথের দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। মিটারে ভাড়া আসার কথা ৯০ থেকে ১০০ টাকা। সেই দূরত্বে চালকরা ভাড়া দাবি করছেন ৩০০ টাকা। মিটারের চেয়ে ৫০ টাকা বেশি দেবেন বলে অনুরোধ করেন আজিজুল। তাতেও কেউ যেতে রাজি হননি। শেষে ২৫০ টাকায় গন্তব্যে যেতে বাধ্য হন। আজিজুল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দিনদুপুরে আমার মতো শত শত যাত্রীর পকেট কাটলেও এ নৈরাজ্য দেখার কেউ নেই। একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, চালকরা রীতিমতো জিম্মি করেই যাত্রী বহন করেন। তবে গন্তব্যে যাওয়ার সময় তারা মিটার চালু করে রাখেন, যা শুধু লোক দেখানো। পান্থপথে সিএনজিচালিত অটোরিকশা খুঁজছিলেন রিয়াজ উদ্দিন। যাবেন গাবতলী বাসটার্মিনালে। অটোরিকশাচালকরা চুক্তিতে কেউ ৩৫০, কেউ ৩৬০ আবার কেউ ৩৮০ টাকা ভাড়া চান। পরে রিয়াজ উদ্দিন বিকল্প উপায় বের করেন। অ্যাপে চালিত একটি মোটরসাইকেলে ১৪০ টাকা ভাড়ায় রওয়ানা দেন গন্তব্যে। যাত্রীসাধারণের এই যে কষ্টের বর্ণনা, বাড়তি ভাড়া আদায় বা মিটার ছাড়া রাজধানীর রাজপথে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালানোর অভিযোগ-জবাবে কী বলেন চালকরা? সরেজমিনে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড, মিরপুর ১০ নম্বর, ফার্মগেট, বাংলামোটর, কাওরান বাজার, পান্থপথ ও শাহবাগে যাত্রীবেশে ১৬ জন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলা হয়। তবে তাদের কেউই মিটারে যেতে রাজি হননি। বাংলামোটর মোড়ে কথা হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক আব্দুল জলিলের সঙ্গে। তিনি বলেন, অনেক বছর ধরেই সিএনজি তো মিটারে চলে না। এখন যাত্রীরাও মিটারের নাম ভুলে গেছে। সবাই দরদাম করেই যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি যাত্রীদের ওপর উলটো দোষ চাপিয়ে বলেন, তারা এসেই জিজ্ঞাসা করেন ভাড়া কত? আমরাও আমাদের যেভাবে পোষায়, সেভাবেই ভাড়া চাই। তবে আব্দুল জলিল কিছু সত্যও অকপটে স্বীকার করেন। মিটারে গাড়ি চালাতে হলে আগে মালিকদের ঠিক করতে হবে। মালিকরা তো সরকারের আইন মানে না। সরকার দৈনিক জমার হার দিনচুক্তি বেঁধে দিয়েছে ৯০০ টাকা। অথচ মালিকরা এক গাড়ি দুই বেলা ভাড়ায় খাটান। বাড়তি জমা আদায়ের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মিরপুরের বাসিন্দা সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক হাবিবুর রহমান পাপ্পু জানান, তার দুটি অটোরিকশা আছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে গাড়ির জমা আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি। যাত্রাবাড়ী এলাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক আব্দুল মান্নান বলেন, সরকার তো জমার হার বেঁধে দিয়েছে ৮ বছর আগে। এরপর দেশে দ্রব্যমূল্য, গাড়ির পার্টসপাতি কয়েক দফায় দাম বেড়েছে। এই হিসাব তো কেউ রাখছে না। এক কাপ রং চা খেতে এখন ১০ টাকা লাগে। এ অবস্থায় এক শিফটে ৯০০-১০০০ টাকা জমা নেওয়া অন্যায় কিছু মনে করেন না তিনি। রাজধানীতে ১৫ হাজার ৬৯৬টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে জানিয়ে ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ খোকন বলেন, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে আশপাশের বিভিন্ন জেলার অটোরিকশা ঢাকায় দেদার চলছে। পুলিশ এসব দেখে না। তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে প্রথম দুই কিমি. ৪০ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা এবং ওয়েটিং বিল প্রতি মিনিট দুই টাকা নির্ধারণ করা হয়। মালিকের জমা নির্ধারণ করা হয় ৯০০ টাকা। এরপর এ পর্যন্ত গ্যাসের দাম পাঁচবার বাড়ানো হলেও ভাড়া সমন্বয় করা হয়নি। বাংলাদেশ অটোরিকশা ও হালকা যান পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম ফারুক বলেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিকরা জমার হার বাড়িয়ে নিচ্ছেন। এ কারণে চালকরাও মিটারে গাড়ি চালাতে চান না। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি, শুরু থেকেই মালিকরা বাড়তি জমা আদায় করছেন। যখন সরকার নির্ধারিত জমা ছিল ৩০০ টাকা, তখন মালিকরা আদায় করতেন ৫০০ টাকা। এখনো তারা একইভাবে অনেকটা জোর করে বাড়তি জমা আদায় করছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ভাড়া নৈরাজ্য নিরসন করতে হলে সুষ্ঠু মনিটরিং ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা এক জরিপে দেখেছি, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় সর্বনিম্ন দূরত্বে সর্বোচ্চ মিটারের চেয়ে পাঁচগুণ ভাড়া আদায় করা হয়। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, মিটার ছাড়া রাস্তায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল নিয়ে শাস্তির বিষয়ে সড়ক আইনে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। এ কারণে মিটারে না চললেও এসব অটোরিকশার বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। বিআরটিএ’র (রোড সেফটি) পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, এগুলো তাদের অজুহাত। তারা কখনই ভাড়া ঠিকমত নেয় না। ভাড়া সমন্বয় করার পরেও তারা ভাড়া বেশি নেয়। এটা তাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এসব অনিয়মের কারণেই ঢাকা শহরে আমরা সিএনজি অটোরিকশা বৃদ্ধি করছি না।বিআরটিএর আশা মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস পুরোদমে চালু হলে সিএনজি অটোরিকশার দৌরাত্ম্য অনেকটা কমবে। কিন্তু, তাদের এসব কথায় সন্তুষ্ট নন সাধারণ যাত্রীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া ভাঙা যাবে না সিএনজি অটোরিকশা চালকদের এই সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, সড়ক আইন অনুযায়ী দরকষাকষি করে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে বিআরটিএ-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত অব্যাহত আছে। কোনো অটোরিকশাচালক মিটারে না চললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আলোকিত প্রতিদিন/ ১০ নভেম্বর ২৩/ এসবি