আলোকিত ডেস্ক:
বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে মতানৈক্য রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের পঞ্চম প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের টু প্লাস টু বৈঠকের পর তা স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হওয়ায় আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ওয়াশিংটন শুরু থেকেই অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের ওপর জোর দিয়ে আসছিল। আর এখন দেশটি নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হোক, সেটাও চাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সব রাজনৈতিক দলকে নিঃশর্ত সংলাপের পক্ষে মত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য ইতোমধ্যে ভিসা নীতিও ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসা দেবে না ওয়াশিংটন। এদিকে বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে শাপে-নেউলে সম্পর্কের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন কূটনীতিকরা। এ কারণেই তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের কূটনীতিকদের আগ্রহ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূ-রাজনৈতিক কারণেই প্রতিবেশী দেশ ভারত, এশিয়ার উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীন, এমনকি বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে চলছে দেনদরবার ও নানা আলোচনা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে চাপে রাখতে কূটনীতিকদের ব্যবহার করছে। প্রকাশ্যে ও গোপন বৈঠকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য কূটনীতিকরাও চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন বৈঠকে খোলামেলা আলোচনায় রাজনীতিকদের মনোভাব জানার চেষ্টা করছেন। দুই দলের নেতাদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আস্থা বাড়াতে বৈঠকেরও চেষ্টা করেছেন। প্রায়ই পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতিকরা নির্বাচন কমিশন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ছাড়াও নিজেদের বাসভবনে বা দূতাবাসে বৈঠকের পর বৈঠক করছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ সব দলের অংশগ্রহণ চায়। তারা বিভিন্ন বৈঠক ও আলোচনায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বার্তাও অব্যাহত রেখেছে। এদিকে গত সোমবার বাংলাদেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পাশাপাশি দেশটি তাদের ভিসা নীতির কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে এ–সম্পর্কিত চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগকেও চিঠি দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এই চিঠি লিখেছেন। অপরদিকে বিরোধী দলের অধিকাংশ নেতা কারাগারে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য সংলাপ কীভাবে হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সাংবাদিকদের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই। তবে আমি এ বিষয়ে (কথা বলা থেকে) বিরত থাকব। গত সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। মিলার বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ নেয় না। আমরা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলকে অন্য দলের চেয়ে (বেশি) সমর্থন করি না। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করি। আরেক প্রশ্নে বলা হয়, বাংলাদেশের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ মানুষ গণতন্ত্র এবং অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পক্ষে। আমেরিকা মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে ভূমিকা পালন শুরু করলে বাংলাদেশের নাগরিকরা খুব আশাবাদী হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ছাড়া সকল প্রধান রাজনৈতিক দল (মার্কিন রাষ্ট্রদূত) পিটার হাস এবং অন্যান্য দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কাজ করছে। মার্কিন সরকারকে বাংলাদেশের ইস্যুতে কেন ভারতের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে? এটা কি ইঙ্গিত করে না যে, বাংলাদেশ (বর্তমান শাসকদের দ্বারা) ইতোমধ্যে ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে? যুক্তরাষ্ট্র কি বিশ্বাস করে যে, ভারতের ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশে কিছু করেছে (কোনো ভূমিকা রেখেছে)? উত্তরে মিলার বলেন, ‘আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করি। আমরা মনে করি বাংলাদেশ সরকারের ভবিষ্যৎ তার জনগণের দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিত। ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আলোচনার বিষয়ে আরেক প্রশ্নের উত্তরে মিলার কোনো জবাব দেননি।এদিকে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভূমিকা রাখা এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পাশে থাকাকে পশ্চিমারা ভালোভাবে নেয়নি। দুটি জাতীয় নির্বাচনকে পশ্চিমারা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ হিসেবে দেখলেও সরকারের পাশে থেকে সমর্থন জুগিয়ে গেছে ভারত। তবে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন সব দেশ তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে, তখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ছিল দিল্লি। ফলে ডালপালা মেলেছিল নানা আলোচনার। অবশেষে নিজেদের অবস্থান জানান দিল ভারত। ঢাকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো মন্তব্য বা হস্তক্ষেপ করবে না ভারত। তবে বাংলাদেশকে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে সহযোগিতা থাকবে দিল্লির।দিল্লির আগের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন দেখছেন না কূটনীতিকরা। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত নিজ নিজ কৌশলগত লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রাখছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে, চীনের আধিপত্য ঠেকানো। এ আধিপত্য ঠেকাতে হলে যেসব দেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি আছে, সেখানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। কারণ, যে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি ওয়াশিংটন। তবে চীন ওই দেশগুলোতে তাদের সম্পর্ক ও আধিপত্য বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, কৌশলগত লক্ষ্য সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বের দিকে জোর দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে শুধু বাংলাদেশই নয়, এ অঞ্চলের অন্য দেশেও একই নীতিতে হাঁটছে তারা। কারণ, যে বিষয়টিতে বেইজিংয়ের সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা, তাতেই নিজ শক্তি দেখছে ওয়াশিংটন। আর তা হলো, গণতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, গণতন্ত্র চর্চা হলে তাদের স্বার্থ রক্ষা হবে। কৌশলগত লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশ ইস্যুতে দ্বিমত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে, এ অঞ্চলে বাড়তে থাকা চীনের আধিপত্য ঠেকানো। ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে, এ অঞ্চলে নিজ প্রভাব ও বলয় বিস্তার। আর দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব চিন্তা করছে। আর ভারত এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করছে তাদের জাতীয় স্বার্থ। কূটনীতিকরা মনে করছেন, এ অঞ্চলের দেশগুলোতে নিজ প্রভাব ও বলয় বজায় রাখতে চায় দিল্লি, যা তাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। কারণ এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও শান্তির দিকে বেশি নজর দিচ্ছে তারা। দিল্লি মনে করে, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র যা করছে, তা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে দেবে। সেই সঙ্গে চীনের প্রভাব বাড়াবে। মূল বিষয় হচ্ছে, এ জন্য ভারত এখনও মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কথা প্রচার করে যাচ্ছে। কারণ হচ্ছে, অভ্যন্তরীণভাবে ভারতে উগ্রবাদের বড় উত্থান হয়েছে; যা বাংলাদেশসহ অন্য প্রতিবেশী দেশের জন্য বড় হুমকির কারণ। ভারতের উগ্রবাদের প্রভাব আশপাশের দেশে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিজ স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমের স্বার্থে প্রতিবেশী দেশে ভারতের এমন সরকার দরকার, যা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ফলে ভারত মনে করে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তাদের স্বার্থ হাসিল হবে। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশে চীন এমন কিছু করতে পারবে না যা ভারতের স্বার্থবিরোধী হবে। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ইস্যুটি ভারতের অগ্রাধিকারে রয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থানের মধ্যে ভিন্নতা দেখেছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত মো. তৌহিদ হোসেনও। তিনি বলেন, আমি এবং আরও কেউ কেউ বরাবরই বলে এসেছি– ভারতে কংগ্রেস বা বিজেপি যে সরকারই থাকুক, এ জন্য বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার থাকাই সুবিধাজনক। বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত-মার্কিন অবস্থান পরস্পরবিরোধী হলেও বর্তমান সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন যত জোরালো হোক, এখানে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে তৎপরতা চলছে, তাতে ভারত বাধা হয়ে দাঁড়াবে না বলে মত দিয়েছেন সাবেক এ কূটনীতিক। কূটনীতিকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের অগ্রাধিকার ছিল সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমন। এখন সেখান থেকে তারা সরে এসেছে। এ কারণেই অনেক হিসাব-নিকাশ করে ২০২১ সালে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল দেশটি। বর্তমানে বিশ্ব পরিস্থিতিতে নিজ অবস্থান দৃঢ় করতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারে রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে অগ্রাধিকারের ভিন্নতা জন্ম দিয়েছে মতানৈক্যের। বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে মতানৈক্য দেখছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন আসবে, তা ভাবার কারণ নেই। কারণ চীন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা সবকিছু চিন্তা করেই বাংলাদেশকেন্দ্রিক গণতন্ত্র বা নির্বাচনের বিষয়ে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর নিজ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থকে কেন্দ্র করে ভারত বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেছে। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের অবস্থান অতীতে যা ছিল, বর্তমানে তা রয়েছে আর ভবিষ্যতেও তাই থাকবে বলে ধারণা করেন এ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের জন্য অস্বস্তির বিষয় তিনটি। তা হলো– অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আয়োজন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা। অন্যদিকে একইভাবে বিএনপিসহ সমমনাদের জন্য অস্বস্তির জায়গাগুলো হলো– সহিংসতা থেকে বিরত থাকা এবং নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে কূটনীতিকদের কোনো অবস্থান না থাকা।
আলোকিত প্রতিদিন/ ১৪ নভেম্বর ২৩/ এসবি