আলোকিত ডেস্ক:
একদিকে রাজনৈতিক অবরোধের উৎকণ্ঠা, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী বাজার দর। সব মিলিয়ে দৈনন্দিন ব্যয় বহনে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেটে জিম্মি থাকা নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এখন ছুটছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক সেলে। তবে রাজধানীতে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে পারছে না টিসিবিও। আর এতে টিসিবির পণ্য প্রত্যাশী অনেককেই হতাশ হয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে। ট্রাকসেল থেকে পণ্য কিনতে ফ্যামিলি কার্ড বা স্মার্ট কার্ডের প্রয়োজন হচ্ছে না। লাইনে দাঁড়িয়ে যে কেউ টিসিবির ট্রাকসেল থেকে পণ্য কিনতে পারছেন। এতে করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ স্বল্প দরে ন্যয্যমূল্যে পণ্য কিনতে হুমড়ি খেয়ে পরছেন। রাজধানীর ৩০টি স্থানে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির কার্যক্রম চলছে। প্রতিটি জায়গায় টোকেনের মাধ্যমে ৩০০ জনকে পণ্য দেওয়া হয়। ট্রাকেও ঠিক সেই পরিমাণ পণ্যই থাকে। ট্রাক এলাকায় যাওয়ার আগেই ভিড় জমে যায়। আবার ট্রাক আসার খবর আশপাশে জানাজানি হলে আরও অনেকে ছুটে আসেন। ততক্ষণে টিকিট প্রায় শেষ। ফলে টোকেন না পেয়ে অনেককেই খালি হাতে ফিরতে হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে থাকা টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাকের পণ্য দুপুর ১টা থেকে ২টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অনেকেই ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে না পেরে অভিযোগ তোলেন নানা অনিয়মের। তাদের প্রধান অভিযোগ, ট্রাক সেল থেকে পণ্য কিনতে আসা লোকজন সবাই ঠিকমতো পণ্য কিনতে পারছেন না। এছাড়াও একই ব্যক্তি একাধিক ব্যক্তির নামে পণ্য নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো কারখানার পেছনে, নাখালপাড়া এলাকা ও এফডিসি–সংলগ্ন এলাকায় টিসিবির ট্রাকে পণ্য বিক্রির স্থানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সকালে ট্রাক আসার পরে টোকেন পেতে ক্রেতাদের হুড়াহুড়ি লেগে যায়। এরপর টোকেন নিয়ে সারিতে দাঁড়ান সবাই। টোকেন দেওয়া শেষ হলে শুরু হয় পণ্য বিক্রি। কিন্তু প্রথম দফায় পণ্য নিয়ে একদল ফিরে যাওয়ার সময় বিষয়টি জানাজানি হয়। তখন দলে দলে আরও অনেকে ছুটে আসেন। মহাখালী সাততলা বস্তি থেকে নাবিস্কো কারখানার পেছনে পণ্য কিনতে আসা সত্তোরর্ধ চেনু মিয়া বলেন, ‘আমি প্রথম দফায় আসতে পারিনি। পরে দুপুরের দিকে এসে দেখি অনেক লোক। লাইনে (সারিতে) দাঁড়ালাম। আমাদের বলেছে পণ্য থাকলে দেবে। না পেলে চলে যাব। এই বৃদ্ধার মতো আরও অনেকেই টিকিটের জন্য অপেক্ষা করলেও তা পাননি। নাবিস্কো কারখানার পেছনে সাড়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করে দেখা গেছে, ১৮০ থেকে ২০০ জন পণ্য না পেয়ে ফিরে গেছেন। টিসিবি এবার টোকেনের ব্যবস্থা করায় ট্রাকে পণ্য বিক্রিতে আগের চেয়ে শৃঙ্খলা ফিরেছে। টোকেন না পেলে তাই কেউ কেউ অপেক্ষা না করে নিজেদের কাজে চলে যেতে পারছেন। আগে এই পদ্ধতি না থাকায় অনেকেই দিনভর অপেক্ষা করেও পণ্য না পেয়ে ফিরতেন। এবার অপেক্ষার বিড়ম্বনা কম। যদিও কমদামে পণ্য পেতে কিছু লোক অপেক্ষা করেন। জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ট্রাক সেলে ৩০০ জনের পণ্য আছে। আর লাইনে দাঁড়িয়েছেন দ্বিগুণেরও বেশি মানুষ। অনেকেই আবার তাড়াহুড়া করে লাইন ছাড়াও পণ্য নিচ্ছেন। ক্রেতাদের ভিড় সামলানো কঠিক হয়ে পড়ে ট্রাকসেলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের। দুপুরে ছালমা বেগম নামের এক নারী বলেন, সকাল থেকে এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন তারা বলছে ট্রাকের সব পণ্য শেষ হয়ে গেছে। এতক্ষণ লাইনে দাড়িয়ে থেকেই কিছুই কিনতে পারলাম না। তারা যদি আগে বলতো তাহলে এতক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হতো না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুরাইন রেলগেট, মতিঝিল বক চত্বর, শনির আখড়া বাসস্ট্যান্ড, খিলগাঁও রেলগেট, প্রেসক্লাবের সামনে, মালিবাগ রেলগেট, ফকিরাপুল বাজার,কাওরান বাজার টিসিবি ভবনের সামনে, সূত্রাপুর থানার পাশের এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকায় নিয়মিত ট্রাকসেলের মাধ্যমে পণ্য সেবা দিচ্ছে টিসিবি। প্রতিদিনই এসব ট্রাকসেলে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। ক্রেতাদের দাবি, ট্রাকসেলের পণ্যের পরিমাণ বাড়ানো হলে অনেকেই এই সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন না। জুরাইনের ডিলার জাকির এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন মোবাইল ফোনে বলেন, মানুষ পণ্য নিতে উপচে পড়া ভিড় করছেন। বিক্রির শুরুতে সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে। ৩০০-এর বেশি টোকেন দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সময়ে সময়ে এসে অন্তত ২০০ মানুষ টোকেন না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। সংখ্যাটা কখনো কখনো আরও বেশি হয়। কম দামে ভালো মানের পণ্য পাওয়ায় চাহিদা অনেকে বেড়েছে। নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার কারণে টিসিবি দেড় বছর আগে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দেয়। এরপর কার্ডের মাধ্যমে দেশের এক কোটি পরিবারের মধ্যে পণ্য বিক্রি চালু করে। বাজারের দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে থাকায় নতুন করে এক সপ্তাহ ধরে খোলাবাজারে আবার পণ্য বিক্রি শুরু করে টিসিবি। বাজারদরের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে পণ্য পাওয়ায় এবারের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছে। টিসিবি বর্তমান কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এমন তথ্য দেন সংস্থাটির মুখপাত্র হুমায়ূন কবির। তিনি বলেন, ‘টোকেনের মাধ্যমে পণ্য দেওয়ার ফলে আগের চেয়ে শৃঙ্খলা এসেছে। আমরা আরও ভালোভাবে বর্তমান কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাই। পাশাপাশি সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কার্যক্রমের পরিসর বাড়ানোর চিন্তাও আছে। টিসিবির পণ্য নেওয়ার জন্য মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। তবে পণ্য পেতে আগের চেয়ে সময় বেশি লাগছে। কারণ, পণ্যগুলো দেওয়া হচ্ছে প্যাকেটে ভরে। ট্রাকে করে মালামাল নিয়ে আসার পরে ডিলারের সহযোগীরা আলু ও পেঁয়াজের মতো মালামাল দুই কেজি করে মেপে প্যাকেটে ভরেন। ডাল ও সয়াবিন তেল অবশ্য মোড়কজাত করা থাকে। ডাল-পেঁয়াজ আগে থেকে প্যাকেট করে রাখলে ভোগান্তি একটু কমতো বলে মনে করেন ক্রেতারা। এফডিসি এলাকার ক্রেতা নাসিমা খাতুন বলেন, ‘টোকেন আগেভাগে পেয়েছিলাম। কিন্তু ঠেলাঠেলিতে পণ্য নেওয়ার সারিতে পেছনে পড়ে যাই। মালামাল প্যাকেটে করে দেওয়ার ফলে সময় বেশি লাগছে। একটু কম দামে পণ্য নেওয়ার জন্য এক বেলা রোদের মধ্যে অপেক্ষা করছি। মালামাল আগে থেকে প্যাকেট করে নিয়ে আসলে সুবিধা হতো। টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, ডিলারেরা পণ্য বিক্রির আগের দিন ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে থাকেন। পরদিন সকালে টিসিবির গুদাম থেকে ট্রাকে পণ্য ভরে সরাসরি বিক্রির জন্য নির্ধারিত স্থানে চলে যায়। এ জন্য আলু-পেঁয়াজ প্যাকেট করার মতো সময় থাকে না। যদিও ডিলাররা পর্যাপ্তসংখ্যক সহযোগী রেখে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। উল্লেখ্য, টোকেন পেলে একেকজন ক্রেতা টিসিবির ট্রাক থেকে দুই কেজি করে মসুর ডাল, আলু ও পেঁয়াজ এবং দুই লিটার সয়াবিন তেল কিনতে পারেন। প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৫০ টাকা, আলু ৩০ টাকা ও মসুর ডাল ৬০ টাকায় এবং প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। টোকেন পাওয়া প্রতিজন একটি প্যাকেজে ৪৮০ টাকার বিনিময়ে এসব পণ্য পেয়ে থাকেন, যা বাজারমূল্যের প্রায় অর্ধেক।
আলোকিত প্রতিদিন/ ২৩ নভেম্বর ২৩/ এসবি