আলোকিত ডেস্ক:
উপকূলে লবণাক্ততা, আর্সেনিক দূষণ আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানীয় জলের সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ৷ গ্রামাঞ্চলে ৩০ কিমি দূরে গিয়ে পানীয় জল সংগ্রহ করতে হচ্ছে আর শহরে গভীর নলকূপেও পাওয়া যাচ্ছে না সুপেয় পানি৷ খুলনা শহর থেকে ৪০ কিমি দূরে দাকোপ উপজেলা৷ সেই উপজেলায় এখন পানীয় জলের প্রধান উৎস একটি গভীর নলকূপ৷ আগের নলকূপগুলো থেকে লবণ পানি ওঠে৷ তাই সেই পানি পান করা যায় না৷ দু’বছর হলো নতুন বসানো এই নলকূপটির পানি সুপেয়৷ এই নলকূপের পানি নিতে প্রতিদিন কম করে হলেও ৩০ হাজার মানুষ ভিড় করেন৷ এই তথ্য জানান খুলনার সাংবাদিক হেদায়েত হোসেন৷ তিনি বলেন, দূর দুরান্ত থেকে মানুষ পানি নিতে আসেন৷ নৌকা যোগে কলসি বা ড্রামে করে তাঁরা পানি নিয়ে যান৷ প্রতি কলসি পানি সংগ্রহ করতে খরচ পড়ে যায় ১০ টাকার মতো৷ তাও সবাই পান না সেই পানি৷ খুলনার উপকূলবর্তী কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপে চলছে লবণ পানির আগ্রাসন৷ দু-একটি গভীর নলকূপে সুপেয় পানি পওয়া যায়৷ বাকি নলকূপে লবণ পানি ওঠে৷ পুকুরের পানিই ভরসা৷ তবে সব পুকুরের পানি পানযোগ্য নয়, নয় নিরাপদ৷ তারপরও ওই সব অঞ্চলে কিছু বড় বড় পুকুর আছে, যেখান থেকে মানুষ পানীয় জল সংগ্রহ করে৷ খুলানা দীঘলিয়া, রূপসা আর ফুলতার নলকূপের পানিতে রয়েছে আর্সেনিক৷ হেদায়েত বলেন, আর্সেনিক, লবণ পানির আগ্রাসন আর পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এই অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট চলছে৷ খুলনা শহরে গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যায় না৷ এই মৌসুমে তাই খুলনা শহরে পানীয় জলের সংকট চলছে বলে জানান হেদায়েত৷ নদীতে জাল দিয়ে আমরা মাছ আহরণ করি, তা বিক্রি করে খাবার কিনি। তবে খাবার জোগাড় করতে আমাদের যতটুকু কষ্ট করতে হয়, তার থেকে বেশি কষ্ট করতে হয় খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য। কথাগুলো বলছিলেন ৩০ বছর বয়সী নারী কুলসুম বেগম। তার বাড়ি খুলনার দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ইউনিয়নের পাটজয়নগর গ্রামে। খুলনা শহর থেকে গ্রামটির দূরত্ব ৫০ কিলোমিটারের বেশি। কুলসুম বেগম বলেন, ‘একটা বড় খাল পেরিয়ে দৈনিক পানি আনতে যাই। আমাদের বাড়ি থেকে মোটামুটি দুই কিলোমিটার দূরে জয়নগর মসজিদের কাছে একটা পুকুর আছে। সেখান থেকে আমার পানি আনতে প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হয়। এই পুকুর থেকে অনেকে ৩০ লিটারের বোতলে পানি নিয়ে ভ্যানে করে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করেন। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ৫০ থেকে ৭০ টাকা দিয়ে এক বোতল পানি কিনতে পারেন। আমাদের সেই সামর্থ্য নেই।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন কুলসুম। লবণাক্ততা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের কারণে উপকূলের পাঁচ উপজেলায় নিরাপদ পানির এ সংকট। ২০০৯ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় আইলা ওই অঞ্চলে আঘাত হানে, তখন প্রায় সব সুপেয় পানির পুকুরগুলো নষ্ট হয়ে যায়। দুর্যোগের ১৪ বছর পরও সেই পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। ওই এলাকায় ‘মিঠাপুকুর’ নামে পরিচিত কয়েকটি পুকুর এবং বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিই তাদের একমাত্র পানীয় জলের উৎস। স্থানীয় কামারখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পঞ্চন কুমার মণ্ডল বলেন, গ্রামে পর্যাপ্ত মিষ্টি পানির পুকুর বা চাপকল নেই। তাই পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহ করা এই এলাকার মানুষের জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ পরিবার সুপেয় পানি পান করতে পারে না। এসব পরিবারের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য সরকার কখনো যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। উপজেলার কালাবগি গ্রামে বসবাস করেন আশরাফুল আলম। পরিবারের জন্য সপ্তাহে দুই দিন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তার পানি আনতে যেতে হয় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে। আশরাফুল বলেন, ‘সুন্দরবনের ভেতরে সরকারের পক্ষ থেকে পুকুর খনন করে দেয়া হয়েছে। বন্য প্রাণীরা যে পুকুর থেকে পানি খায়, সেখান থেকে পানি নিয়ে এসে আমরাও খাই। শুধু কালাবগি বা জয়নগর গ্রাম নয়, পুরো দাকোপ উপজেলায় এমন সুপেয় পানির সংকট। সংকট রয়েছে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায়ও। বাংলাদেশের দক্ষিণের বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ ১৬টি জেলার কোনোটাতেই পর্যাপ্ত সুপেয় পানি নেই৷ সবখানেই লবণ পানির আগ্রাসন৷ কোথাও কোথাও আবার নলকূপের পানিতে রয়েছে আর্সেনিক৷ পিরোজপুরের সাংবাদিক দেবদাস মজুমদার বলেন, এই অঞ্চলের গ্রামের মানুষ পুকুরের পানির ওপরই নির্ভরশীল৷ তবে পুকুরগুলোর দীঘদিন সংস্কার হয় না৷ ফলে অনেক সময়ই এলাকাবাসীরা বাধ্য হয়ে দূষিত পানি পান করেন৷ সিডরের পর কয়েকটি দাতা সংস্থার উদ্যোগে পিরোজপুরের বিভিন্ন উপজেলায় পুকুরের পানি বিশুদ্ধ করে পানের উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ এ জন্য পন্ড স্যান্ড ফিল্টার বা পিএসএফ বসানো হয় পুকুরে৷ কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তার অধিকাংশই আজ অকেজো হয়ে গেছে৷ আর যেগুলো সচল আছে তা থেকে পানি নিতে দূর দুরান্ত থেকে নারী-পুরুষরা ভিড় করছেন৷ কেউ কেউ আবার বৃষ্টির পানি ধরে রাখছেন পানীয় জলের জন্য৷ ২০১৬ সালে নেপোটিজম অ্যান্ড নেগলেক্ট: দ্য ফেইলিং রেসপন্স টু আর্সেনিক ইন দ্য ড্রিংকিং ওয়াটার অফ বাংলাদেশ’স রুরাল পুয়র- শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডাব্লিউ জানায়, বাংলাদেশের প্রায় দু’কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকির ভেতর রয়েছে৷ এছাড়া প্রতিবছর ৪৩ হাজার মানুষ আর্সেনিকজনিত রোগে মারা যাচ্ছেন৷ দেশে খাওয়ার পানিতে আর্সেনিক শনাক্ত হওয়ার ২০ বছর পরও বাংলাদেশ সরকার এই সমস্যার প্রতিকারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে৷ এইচআরডাব্লিউ-র দাবি, ‘আর্সেনিক দূষণের শিকার অধিকাংশ মানুষের ত্বকে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না৷ অথচ আর্সেনিকের কারণে অনেকক্ষেত্রেই ক্যানসার, হৃদরোগ ও ফুসফুসের সমস্যা তৈরি হচ্ছে৷ তাই অনেকে জানেনই না যে তাঁরা আর্সেনিক সমস্যায় আক্রান্ত৷ এদিকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন পানির চাহিদা ২৫০ কোটি লিটার৷ কিন্তু সরবরাহ করা হয় মাত্র ২০০ থেকে ২০৫ কোটি লিটার৷ অর্থৎ ৪৫ কোটি লিটার ঘাটতি থেকে যায়৷ ঢাকায় এক দশকে আড়াই মিটার হারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে৷ এছাড়া ওয়াসার পানি পানযোগ্য কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷ তাই পানীয় জল হিসেবে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে বোতলজাত পানির চাহিদা বাড়ছে৷ ওয়াটার এইড-এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের দু’কোটিরও বেশি মানুষ নিরপাদ পানি থেকে বঞ্চিত৷ তাদের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সি কমপক্ষে ৪,১০০ শিশু মারা যায় নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধার অভাবে৷ ২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপে দেশের উপকূলীয় মানুষের নিরাপদ খাওয়ার পানির দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই পাঁচ উপকূলীয় উপজেলার ৭৩ শতাংশ মানুষকে অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করতে হচ্ছে। ওই জরিপে দেখা গেছে, উপকূলীয় পাঁচ উপজেলার মানুষের প্রতি লিটার খাওয়ার পানিতে ১ হাজার ৪২৭ মিলিগ্রাম থেকে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা রয়েছে। প্রতি লিটারে ১০০০ মিলিগ্রামের বেশি লবণাক্ততা থাকলে তা খাওয়ার অনুপযোগী বলে গণ্য করা হয়। এলাকাবাসী পানি সংগ্রহ করে এ রকম ৫২ শতাংশ পুকুর ও ৭৭ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। জরিপে গড়ে দাকোপ উপজেলার পুকুরগুলোতে ৬৫০ মিলিগ্রাম, কয়রায় ১ হাজার ২৪ মিলিগ্রাম, পাইকগাছায় ১ হাজার ৫৮১ মিলিগ্রাম, আশাশুনিতে ১ হাজার ২০৩ মিলিগ্রাম এবং শ্যামনগরে ১ হাজার ১৮৪ মিলিগ্রাম লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া টিউবওয়েলের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা রয়েছে দাকোপে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম, কয়রায় ১ হাজার ৪৫৩ মিলিগ্রাম, পাইকগাছায় ১ হাজার ৫১০ মিলিগ্রাম, আশাশুনিতে ৯৯৮ মিলিগ্রাম ও শ্যামনগরে ১ হাজার ৬৮৩ মিলিগ্রাম। এ ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে বা শীতকালে শ্যামনগর উপজেলার টিউবওয়েলের প্রতি লিটার পানিতে ৬ হাজার ৬০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা পাওয়া গেছে, যা অনুমোদিত সীমার ছয় গুণের বেশি। পাঁচটি উপকূলীয় উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়নে ৬৬ হাজার ২৩৪টি পরিবারের ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৪ জনের মধ্যে ওপর ‘জেন্ডার-রেসপন্সিভ কোস্টাল অ্যাডাপটেশন (জিসিএ)’ শীর্ষক এ জরিপ চালানো হয়। জরিপে বলা হয়, অনেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে দৈনিক দুই ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করেন। কখনো কখনো টিউবওয়েল বা পুকুর থেকে পানি আনতে তাদের এক কিলোমিটারের বেশি হাঁটতে হয়। ৬৩ শতাংশ মানুষ সেই পানি পেতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। কারণ তাদের খাওয়ার পানির অন্য কোনো উৎস নেই। জরিপে আরও দেখা গেছে, ঢাকা শহরের একটি পরিবারকে পানি সংগ্রহের যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হয়, উপকূলে সমপরিমাণ সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য আরও বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। খুলনা অঞ্চলের নদ-নদী ও পরিবেশ নিয়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে গবেষণা করছেন গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানছে। একই সঙ্গে নদ-নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। সেখানে লবণপানির চিংড়ি চাষের কারণে সুপেয় পানির পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণেও অনেক পুকুর লোনাপানিতে ভরে গেছে। পরে তা সংস্কার করা হয়নি। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রাখার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই। সরকারের উচিত সেখানে নতুন নতুন পুকুর খনন করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের উপকরণ বিতরণ করা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর অধিদপ্তরের খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. বাহার উদ্দীন মৃধা বলেন, ‘লবণাক্ত এলাকায় পানির সংকট মোকাবিলায় সব সময় আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমরা চলতি বছরেও বেশ কিছু পুকুর সংস্কার করেছি। অনেক পরিবারের মাঝে পানির ট্যাংক বিতরণ করেছি।
আলোকিত প্রতিদিন/ ১ ডিসেম্বর ২৩/ এসবি