বাড়ছে ভূমিকম্পের ঝুঁকি, মোকাবিলায় প্রস্তুতি কম

0
372

আলোকিত ডেস্ক:

দিনকে দিন ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে দেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভূমিকম্পের তেমন কোনো পূর্বাভাসের ব্যবস্থা নেই। ভূমিকম্পের এমন ঝুঁকি থাকলেও মোকাবিলার প্রস্তুতি অনেকটাই কম রয়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। গত ৭ মাসে দেশে অন্তত ১০ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সবশেষ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আজ শনিবার সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, শেরপুর, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্পের খবর পাওয়া গেছে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অফিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তা রবিউল হক। তিনি বলেছেন, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬। এদিকে কুমিল্লায় ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে একটি পোশাক কারখানা থেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ৮০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া এ রিপোর্ট লেখা পযর্ন্ত বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকি মাথায় রেখে অবিলম্বে পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়া উচিত বাংলাদেশের। কারণ ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ভূমিকম্পের বিষয়ে সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে বাংলাদেশে, যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও ভূমিকম্প মোকাবিলায় তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। বড় ভূমিকম্প এদেশে হলে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তারা বলছেন, রাজধানী ঢাকার মতো বড় শহরগুলোয় যে পরিমাণ বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্পে এসব ভবন ধসে পড়লে শহরগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যার কারণে ব্যাহত হবে উদ্ধার কাজ। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এই নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। মৃত্যু হতে পারে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষের। কারণ, আমাদের ভবনগুলো এখনো নিরাপদভাবে তৈরি হচ্ছে না। ঢাকা শহরের প্রায় সব বাড়িতে তিতাস গ্যাসের লাইন আছে। প্রয়োজন ছাড়া গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখা ভূমিকম্পের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত ভয়ংকর। এমএমআইয়ের ৮ স্কেলের ঝাঁকুনিতে রান্নাঘরের গ্যাস বার্নার থেকে মুহূর্তে আগুন ধরে যেতে পারে। গত মাসে দেশে ১০ বার ভূমিকম্প : এ বছর প্রথম ভূকম্পন অনুভূত হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের পাশাপাশি সেদিন কেঁপে ওঠে সিলেট। ৩ দশমিক ৯ মাত্রার এ ভূমিকম্পে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে মাঝারি মাত্রার দুটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। দেশটির আয়াবতি ও রাখাইন রাজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের কক্সবাজারেও ভূকম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার আগারগাঁও থেকে ৩৭৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। এদিকে ৩০ এপ্রিল ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে চট্টগ্রাম। ৫ মে আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছে বিক্রমপুরের দোহার থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এটির গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। গত ১৬ জুন রাজধানীসহ সারা দেশে ৪ দশমিক ৫ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ। ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪৯ মিনিটের দিকে একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ঐ ভূমিকম্পে রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকা কেঁপে ওঠে। মাত্রা রিখটার স্কেলে ছিল ৫ দশমিক ৫, যা মাঝারি মাত্রার একটি ভূমিকম্প। এর উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়। গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। আগস্ট মাসে দুই দফায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মধ্যে একটি হয় ২৯ আগস্ট। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট। এরপর ১৪ আগস্ট আরেক বার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্রস্থল ছিল সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়। এরপর ৯ সেপ্টেম্বর আরেকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসামের কাছাড় এলাকা। দুইদিন পরেই ১১ সেপ্টেম্বর সিলেট এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত। এছাড়া ১৮ সেপ্টেমর পর্যন্ত ঢাকা ও এর উত্তরের কয়েকটি জেলায় হালকা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ২, যা মাত্রা অনুযায়ী হালকা ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয়। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলে। এদিকে বহু পুরোনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সঠিক সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী মনে করেন, ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা গেছে। তার মানে, যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। জাতিসংঘ বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা একটি। এছাড়া বাংলাদেশ পৃথিবীর ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত বিধায় প্রাচীনকাল থেকে এ দেশে মাঝে মধ্যে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। উপরন্তু হিমালয় রেঞ্জ হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। যদিও সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের জনগণ শক্তিশালী ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়নি। ছোট ভূমিকম্প কি বড় ভূমিকম্পের আলামত : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ভূমিকম্পের মূল যে জায়গা ধরা হয় সেটি হচ্ছে উত্তর-পূর্ব অঞ্চল যা সিলেটের অন্তর্গত। এই অঞ্চল টেকটোনিক প্লেটের কাছাকাছি। এ ছাড়া আসাম, শিলংয়ে প্লেট আছে। এসব জায়গায় ভূমিকম্প হলে সেটির প্রভাব পড়ে দেশের মধ্যে। তবে এমন ছোট ছোট ভূমিকম্পের ধারাবাহিকতায় হঠাৎ বড় ভূমিকম্প হবে কি না সেটি নিয়ে আগে থেকেই কিছু বলা যাবে না।  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ভেতরে ও সীমান্তের কাছাকাছি ৫টি ফল্ট জোন (ভূ–চ্যুতি অঞ্চল) সক্রিয় আছে। এ ফল্ট জোনগুলো বগুড়া ফল্ট জোন, ত্রিপুরা ফল্ট জোন, ডাউকি ফল্ট জোন, আসাম ফল্ট জোন এবং শিলং মালভূমি ফল্ট জোন। এর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক হতে পারে ডাউকি ফল্ট জোন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড সুব্রত কুমার সাহা  বলেন, এমন ভূমিকম্প সাধারণ বিষয়। বছরে ওই অঞ্চলে ২০ থেকে ২৫ বার এমন কম্পন অনুভূত হয়। গত ১৬ জুনের ভূমিকম্পের উৎপত্তি ডাউকি ফল্টের কারণে হয়েছে।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং বর্তমানে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘এমন ছোট ছোট ভূমিকম্প মূলত বড় শক্তি নিয়ে ভূমিকম্প হওয়ার প্রাথমিক ধাপ। এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। আর বড় কোনো কিছু হলে আগে ছোট কিছু বিষয় ধরা পড়ে। তবে সুব্রত কুমার সাহা বলেন, ‘ছোট কম্পনের ফলে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমে যেতে পারে। আবার বাড়তেও পারে। দেশে এই দুই ধরনের পর্যালোচনা আছে। অনেকেই মনে করেন, ছোট ভূমিকম্প হলে বড় কিছু হতে পারে। আবার অনেকেই ভাবেন, এর ফলে প্রেশার কমে যায়, যাতে বড় ভূমিকম্প না হয়। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেটের ফল্ট লাইনে দিনের বেলা ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হলে কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫ ভবন ধসে পড়তে পারে। ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকার সমমূল্যের। ২০০৯ সালে সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাপানের সহায়তা সংস্থা জাইকার যৌথ জরিপে বলা হয়, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে। ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে ৭ কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ।  রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় মোট ভবন ২১ লাখ ৪৭ হাজার ২১৯ টি। এর মধ্যে পাকা ভবন ৫ লাখ ১৩ হাজার ৬০৭টি। আর নির্মাণাধীন ২০ হাজার ৩২ টি।  নগর পরিকল্পনাবিদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর-অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘ভূমিকম্প হবে ধরে নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রথম ধাপ হচ্ছে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ও কাঠামোগত যেসব দিক নির্দেশনা আছে তা মেনে ভবন করতে হবে। যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে পাঁচটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ‘১০০ থেকে ১৫০ বছর পরপর ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে অনুযায়ী, বাংলাদেশে যেকোনো সময় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য আমাদের প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও স্থাপত্য, পরিকল্পনা ও পুরকৌশল বিভাগ থেকে পাস করা সদ্য স্নাতকদের ভূমিকম্পসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া ঢাকা শহরের ভবনগুলো ভূমিকম্প-সহনীয়ভাবে নির্মাণ ও নির্মিত ভবন কতটা ভূমিকল্প-সহনীয়, তা জানার জন্য তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তদারকির ব্যবস্থার পরামর্শ দেন তিনি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক চেয়ারম্যান ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) সভাপতি নুরুল হুদা বলেন, ‘ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর প্রস্তুতি আমাদের নেই। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য সরকারকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে, পেশাজীবীদেরও যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সঠিক সমন্বয়ের প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, রাজউকের আওতাধীন ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান কাজ করে, এগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করার জন্য একটি মহানগর সরকার করা যেতে পারে, এখানে একজন মন্ত্রী থাকবেন। যার দায়িত্ব হবে এই ৫০-এর অধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন ও বিধিমালার সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো নিরসন করা। এ ছাড়া নতুন প্রতিটি ভবন যাতে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)’ অনুযায়ী নির্মিত হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে এবং বিএনবিসি না মেনে নির্মাণ করা পুরোনো ভবনগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। ২০১০ সালে হাইতি ও চিলিতে ভূমিকম্পে প্রাণহানির তথ্য তুলে ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, হাইতিতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৩ লাখ ১৬ হাজার এবং চিলিতে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৫১৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ভূমিকম্পের পরও চিলিতে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, চিলিতে ষাটের দশকে ভূমিকম্পের পর ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড তৈরি করা হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে এই কোড মেনেই সব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, এ জন্যই ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। বাংলাদেশেও বিল্ডিং কোড তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। বিল্ডিং কোড প্রয়োগ করতে পারলেই প্রকৃত সাফল্য আসবে উল্লেখ করে অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, বিল্ডিং কোডের পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত সব আইন ও বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক দিলারা জাহিদ বলেন, ‘২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে বলে বলা হচ্ছে, কিন্তু ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন নির্মাণ করতে না পারলে সব উন্নয়নই শেষ হয়ে যাবে। ধীরে চলো নীতির পরিবর্তে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস করতে হবে যে আমরা ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে আছি। এই আতঙ্কের মধ্যে থেকেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় ঝুঁকি হ্রাসে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চের (সিএইচবিআর) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক বলেন, ঝুঁকি হ্রাসে ১ টাকা বিনিয়োগ করলে দুর্যোগকালে সেটি ১০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচাবে। ভবন নির্মাণে পোড়ামাটির ইট ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পোড়ামাটির ইট ব্যবহার করলে ভবনের ওজন বাড়ে, এতে ভবনে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা আরও বাড়ে। ইটের পরিবর্তে তিনি ব্লক ব্যবহারের পরামর্শ দেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ‘আমরা স্মার্ট, ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি; কিন্তু এখনো ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা দেওয়াসংক্রান্ত প্রযুক্তি স্থাপন করতে পারিনি। এখন ভূমিকম্প-সহনীয় নগর গড়ার কাজ শুরু করে দিতে হবে। ভবন যাতে ভূমিকম্প-সহনীয় হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের (যার যে দায়িত্ব) সঠিক দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘তুরস্কে পেশাগত নীতিনৈতিকতা মেনে যেসব প্রকৌশলী ও ডেভেলপার ভবন নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে, আমাদেরও ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পেশাগত নীতিনৈতিকতা কঠোরভাবে মানতে হবে। জিপিএইচ ইস্পাতের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) আবু সাঈদ মো. মাসুদ পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলসেতুর উদাহরণ টেনে বলেন, ‘বড় অবকাঠামোগুলো ভূমিকম্প-সহনীয় করে নির্মাণ করা হচ্ছে, তাহলে ছোট অবকাঠামোগুলো (ভবন) কেন ভূমিকম্প-সহনীয় করে নির্মাণ করতে পারব না?’ ভবনের চেয়ে মানুষের জীবন অনেক বেশি মূল্যবান উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের মাঝে এই বোধোদয় হতে হবে যে ভবনের ক্ষয়ক্ষতি হলে কিছু আসে যায় না, মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে। আর জীবন বাঁচানোর জন্য যা যা করার প্রয়োজন, তা আমাদের করতে হবে।

আলোকিত প্রতিদিন/ ২ ডিসেম্বর ২৩/ এসবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here