উচ্চ শব্দে হাসপাতালে রোগীর ত্রাহি অবস্থা

0
222

আলোকিত ডেস্ক:

২০০৬ সালের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুযায়ী, কোথাও কোনো হাসপাতাল থাকলে সেটি ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর ‘নীরব এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোনো প্রকার হর্ন বাজানো যাবে না’। রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে রাস্তার দু’পাশে দুটি দেশখ্যাত হাসপাতাল। একপাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। অপর পাশে বারডেম জেনারেল হাসপাতাল। দেশের এই বড় দুই হাসপাতালে শত শত রোগী প্রতিদিন চিকিৎসা নেন। মুমূর্ষু রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি থাকেন। কিন্তু নানা রকম যানবাহনের মুহুর্মুহু হর্নের আওয়াজে রোগীদের ত্রাহি অবস্থা হয়। কিন্তু কোনো ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই গাড়ির তীব্র হর্ন এখানে প্রতিনিয়ত বেজেই যাচ্ছে। তাই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে এখানকার রোগীরা। বলা হয় জীবনভর শব্দের সঙ্গেই মানুষের বসবাস। মৃদু, কোমল, জোরালো আর কানফাটা, উচ্চণ্ড—কতো রকম শব্দ যে আমাদের জীবন ঘিরে রয়েছে! কিন্তু শ্রবণযন্ত্র বা কানের জন্য শব্দের সহনীয় মাত্রা আছে। সহনীয়তার মাত্রা ছাড়ালেই সে শব্দ হয়ে ওঠে পীড়াদায়ক। তখন তাকে বলা হয় শব্দদূষণ। শব্দের এই দূষণ মারাত্মক ক্ষতিকর। কেননা এ দূষণের ফলে প্রতিক্রিয়াটি সরাসরি মস্তিষ্কের উপর পড়ে। স্নায়ুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ক্রমাগত শব্দদূষণের প্রভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয় বলে তা স্বাভাবিক জীবনধারায় ব্যাঘাত ঘটায়। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা, ইউনিসেফ এবং বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৩০টি কঠিন রোগের উৎস ১২ রকমের পরিবেশ দূষণ। এদের অন্যতম হচ্ছে শব্দদূষণ। স্বাভাবিক মানুষের শব্দের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ ডেসিবল। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় যানবাহনের উচ্চ শব্দ ও হাইড্রোলিক হর্নের শব্দের মাত্রা ১২০ থেকে ১৮০ ডেসিবল পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্বাভাবিক মানুষজন এ মাত্রার শব্দ সহ্য করতে পারলেও রোগীদের পক্ষে তা একেবারেই অসম্ভব। রাজধানীর বেশিরভাগ হাসপাতাল এই দূষণের আওতার মধ্যে। অথচ এগুলোর ব্যাপারে নেই কোনো  নজরদারির ব্যবস্থা। রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেল শব্দদূষণের নাজুক পরিস্থিতি। বারডেম হাসপাতালে যেন ভোগান্তির পরিমাণটা একটু বেশি। বারডেমে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে ভর্তি আছেন নিহারিকা চৌধুরী। তার ভাষ্যমতে, আইসিইউতে যতদিন ছিলাম, ভালো ছিলাম। এখন ওয়ার্ডে আসার পর থেকে নিজেকে অনেক বেশি অসুস্থ মনে হয় শুধু বাইরের বিরক্তিকর প্রচণ্ড শব্দের কারণে। এই উচ্চণ্ড শব্দ খুব কানে লাগে ঘুমানো যায় না। রাত ১১টার পর একটু শান্তি পাই। তাও মাঝে মাঝে হঠাৎই মাঝরাতেও দুই একটা বিকট হর্নের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।  এ রকম অভিযোগ হাসপাতালটির বেশিরভাগ রোগীর। অনেক সময় কানে তুলা গুঁজে রেখে দিন কাটান রোগীরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি রোগীদের অনেকে জানান একই কথা। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, রোগী ও স্বজনদের ছোটাছুটি চলছে। গাজীপুর থেকে আসা রোগী মো. সাইফুল কাতর মুখে বললেন, ‘হৃদরোগের চিকিৎসা নিতে এসে মাথায় যন্ত্রণা নিয়ে ফিরছি। গাড়ির হর্নের শব্দ যেন মগজে ঢুকে আছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেট বলছে, উচ্চমাত্রার শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তি ও স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। কানে শোনার ক্ষমতা কমে যায়, ঘুম কম হয়, বিরক্তির মাত্রা বেড়ে যায়। শব্দের কারণে শিশুদের শেখার ক্ষমতা কমে যায়। হৃরোগের, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিও হয় দীর্ঘ মেয়াদে। ‘স্বাস্থ্যে শব্দের প্রভাব’ শীর্ষক ওই প্রবন্ধে বলা হয়, আচমকা শব্দে (ইমপালস সাউন্ড) ও দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ শব্দের (৭৫ থেকে ৮৫ ডেসিবেল) মধ্যে থাকলে মানুষ শ্রবণক্ষমতা হারাতে পারে। কারণ, এতে কানের কোষ (সেল) মারা যায়। কানের কোষ মারা গেলে তা মনোযোগের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এই কোষ নতুন করে আর তৈরি হয় না।  শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে আইন ও বিধি রয়েছে, তা নিয়ে দু-এক বছর পরপর প্রচারণা চলে। কিন্তু কয়েক দিন চলার পর সব ঝিমিয়ে পড়ে। বিধি অনুযায়ী, নীরব এলাকায় হর্ন বাজালে প্রথমে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। আবার নিয়ম ভাঙলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা জরিমানা করা হবে। কিন্তু এর প্রয়োগ হয় না বললেই চলে।   পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের ২০১৬ সালের জরিপে আটটি বিভাগীয় শহরের ২০৬টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করে। এই স্থানগুলোতে ১৩০ ডেসিবেল পর্যন্ত আকস্মিক শব্দের মাত্রা রেকর্ড করা হয়। কোনো কোনো স্থানে মাত্র ১০ মিনিটে ৯০০ বারের অধিক হর্ন বাজতে দেখা যায়। অতিরিক্ত হর্ন বাজানো এসব স্থানে যাঁরা বসবাস করছেন, তাঁরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার পরও যানবাহনে বিকট আওয়াজ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার অব্যাহত আছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আরেকটি আদেশ এসেছে উচ্চ আদালত থেকে। দূরপাল্লার বাস-ট্রাক শহরের ভেতর দিয়ে চলাচলের সময় হর্নে কান পাতা দায়। রাস্তায় নামলে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল আর নানা পদের যানবাহনের শব্দে দিশাহারা লাগে বলে অনেকে জানান।  পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক জরিপ বলছে, দিনের বেলায় নীরব এলাকা ইডেন কলেজের সামনে ১০৪ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকা পল্টনে ১০৫ ডেসিবেল, কলাবাগানে ১০৬ ডেসিবেল, এয়ারপোর্টের সামনে ১০৮ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ ধারণ করা হয়েছে। নগরীর আবাসিক এলাকাগুলোতে রাতের বেলায় শব্দের মাত্রা ৬৮ ডেসিবেল থেকে ৮৩ ডেসিবেল পর্যন্ত ওঠা-নামা করে। শব্দদূষণের জন্য দায়ী কে: এই উচ্চ শব্দের জন্য দায়ী কে? দেশের প্রধান শহরগুলোতে শব্দদূষণের জন্য যানবাহনের হর্নকেই দায়ী করেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের করা এক গবেষণা। গবেষণায় বলা হয়, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরবাইকের হর্ন এই উচ্চমাত্রার শব্দের প্রধান উৎস। এই বাহনগুলো অপ্রয়োজনে ও অহেতুক হর্ন বাজায়।  বাংলামোটর মোড়ে ২২ নভেম্বর বেলা দেড়টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহনের লম্বা জট ছাড়তেই একসঙ্গে তীব্র হলো হর্নের আওয়াজ। চোখের দেখায় ৪৮টি বাস-মিনিবাস ও মোটরবাইক হর্ন বাজাতে বাজাতেই মোড় পার হলো।  মোড়ের অটো পার্টসের দোকানি সাইফুল ইসলাম বিরক্তি নিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তিনি দোকানে বসেন। বললেন, ‘মানুষরে বললেও শোনে না। দেখতেছে সিগন্যাল, তা-ও হর্ন বাজায়। হর্ন বাজানো মানুষের একটি বদভ্যাস হয়ে গেছে। ল্যানসেট-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৩ ডেসিবেল শব্দে মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। শব্দের কারণে অনিয়মিত ঘুমে মানুষের বিরক্তিসহ দীর্ঘ মেয়াদে শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। হাসপাতালগুলোতে শব্দ সংবেদনশীল পরিবেশের কথা থাকলেও বেশির ভাগ হাসপাতালে তা থাকে না। হাসপাতালের রোগী ও কর্মীদের ওপর দিনকে দিন শব্দের বাজে প্রভাবের মাত্রা বাড়ছে। তাতে রোগী সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগছে। হাসপাতালে রোগীকে ঘুমানোর জন্য বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ বা ডোজ দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। উচ্চ আওয়াজের ক্ষতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নাক, কান ও গলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল হাসান তরফদার বলেন, ‘কেউ যদি ক্রমাগত সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দ শুনতে থাকে, তাহলে একপর্যায়ে আংশিক; পরে স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি লোপ পেতে পারে। এমনকি প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে হেডফোনে গান শুনলে পাঁচ বছরের মধ্যেই শ্রবণক্ষমতা কমতে থাকবে। তাহলে রাস্তার উচ্চ শব্দে কী ক্ষতি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পরিচালক ব্রিগে. জেনা. মো, আবদুল্লাহ আল হারুণ বলেন, হার্টের রোগী ও অপারেশনের রোগীদের সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি হয়। স্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুষদের চেয়ে রোগীরা অস্বস্তিকর অবস্থায় থাকেন সবসময়। তাই শব্দদূষণ তাদের একেবারেই সহ্য হয় না। আমরা হর্ন বাজানো যাবে না এমন চিহ্ন রাস্তায় লাগিয়েছি। আরও লাগাবো। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেছি। আশা করি খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।  এদিকে দেশের নামিদামি হাসপাতালগুলোতে এই ভোগান্তির পরিমাণ কিছুটা কম হলেও একেবারে যে নেই তা বলে বলা যায় না। স্কয়ার, ল্যাবএইড, আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কক্ষগুলো বাতাসরোধী ও শীতাতাপ হবার কারণে শব্দ কিছুটা কম প্রবেশ করে। তবে অন্যসব হাসপাতারের ক্ষেত্রে ভোগান্তি একেবারে শীর্ষে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় আবার ভিন্ন পরিস্থিতি। এখানে শুধু বাইরের শব্দদূষণ নয়, হাসপাতালের ভেতরেও শব্দদূষণের মাত্রাও ব্যাপক। দর্শনার্থীসহ বিভিন্ন রকম মানুষের যাতায়াতে মুখরিত এ হাসপাতালে সবার মুখের কথার কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে শব্দদূষণ। এছাড়া হাসপাতালের গেটের ভিতরেও ঢুকে হর্ন বাজায় হাসপাতালে আগত অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্যান্য গাড়ি। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্মরত ডাক্তার মো. আবিদ বলেন, প্রচণ্ড গোলমেলে শব্দের কারণে প্রায়ই দেখা যায় রোগীরা ঘুম থেকে আৎকে জেগে ওঠেন। রাস্তার শব্দ অনেক সময় রোধ করা যায় রুমকে বায়ুরোধক করার মাধ্যমে। আইসিইউতে যেমন আছে। হাসপাতালের ভিতরের মানুষের সংখ্যা কমাতে না পারলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। আমরা মাঝেমাঝে হার্টের রোগে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে ব্যাপক চিন্তিত হয়ে পড়ি এই শব্দ দূষণের কারণেই। ওষুধ দিয়েও কাজ হয় না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘শব্দদূষণ যারা করছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর চেয়ে এই আইন ও বিধিগুলো সম্পর্কে মানুষকে জানানোটা অনেক বেশি জরুরি। আমরা এ বিষয়ে খুব দ্রুত প্রচারণা শুরু করব। কোন এলাকায় কেমন শব্দ হওয়া উচিত, কেমন হচ্ছে হাসপাতাল, আবাসিক, বাণিজ্যিক, মিশ্র ও শিল্প এলাকা-নগরীর কোনো এলাকাকে কি নীরব এলাকা বলা যায়? শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালায় এই এলাকাগুলোর শব্দের সহনীয় মানমাত্রা দিনের বেলায় সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবেল নির্ধারণ করা হয়েছে। রাতের বেলায় তা আরও ৫ একক কম।

আলোকিত প্রতিদিন/ ৩ ডিসেম্বর ২৩/ এসবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here