দুর্বল হয়ে পড়ছে মাটির স্বাস্থ্য

0
227

আলোকিত ডেস্ক:

বাংলাদেশের মাটির স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে পড়ছে। মাটিতে রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ কমে আসছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাটির যত্ন না নেওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে খাদ্য উৎপাদনে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) কর্মকর্তারা বলছেন, সারা দেশের মাটিতেই প্রয়োজনের তুলনায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, দস্তা ও বোরনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া অঞ্চলভেদে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের ঘাটতি আছে। দেশের প্রায় সব উপজেলার মাটি পরীক্ষা করে এসআরডিআই এ তথ্য পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে  ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মাটি দিবস পালিত হচ্ছে। মৃত্তিকাবিজ্ঞানীরা মাটির তিন ধরনের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলেন। সেগুলো হলো ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক। মাটির রং, মাটি নরম না শক্ত—এগুলো ভৌত চরিত্রের অংশ। বিভিন্ন ধরনের পদার্থ মাটির রাসায়নিক চরিত্র নির্ধারণ করে। অন্যদিকে মাটিতে থাকে অতি ক্ষুদ্র অণুজীব থেকে ছোট ছোট পোকা ও কেঁচোর মতো প্রাণী। এদের উপস্থিতি মাটির জৈব চরিত্র ঠিক করে দেয়। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ৫ শতাংশ হলে সে মাটিকে সবচেয়ে ভালো বলা হয়। ন্যূনতম ২ শতাংশ থাকলে সেটিকে ধরা হয় মোটামুটি মানের। কিন্তু দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এখন গড়ে ২ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। এছাড়া জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে, যা দেশের মোট জমির প্রায় ৭৯ শতাংশ। মাটির উর্বরতা শক্তি ও জৈব পদার্থের উপস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)। ‘ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ সমীক্ষায় মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি ও নানা পুষ্টিকণা কমে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি ভূমিক্ষয়, অম্লমাটির পরিমাণ, উপকূলের লবণাক্ত এলাকা ও খরাপ্রবণ এলাকায় কী পরিমাণ মাটি রয়েছে—তারও পূর্ণাঙ্গ তথ্য উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির সমীক্ষায়। এতে দেখা যায়, দেশে সব ধরনের বিশেষ করে আবাদি, বনভূমি, নদী, লেক, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সুন্দরবন ইত্যাদি এলাকা মিলিয়ে জমির পরিমাণ ১ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে ফসফরাস ঘাটতিযুক্ত এলাকার পরিমাণ ৬৬ লাখ হেক্টর, যা মোট জমির প্রায় ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে পটাশিয়ামের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫২ লাখ ৭০ হাজার বা ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশে। সালফারের ঘাটতি রয়েছে ৬৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বা ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ এলাকায়। এর বাইরে বোরনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫১ লাখ ১০ হাজার হেক্টরে (মোট জমির ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ)। জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর বা মোট জমির প্রায় ৭৮ দশমিক ৯০ শতাংশে। এসআরডিআইয়ের তথ্যমতে, পদ্মা অববাহিকা ও হাওড়াঞ্চলের কৃষিজমিতে স্বাভাবিকের তুলনায় দস্তার পরিমাণ কম। এর মধ্যে পদ্মা নদীর অববাহিকার মাটিগুলোয় চুন ও ক্ষারের (পিএইচ) মাত্রা অনেক বেশি। অন্যদিকে হাওড়াঞ্চলের জেলাগুলোয় আবাদি এলাকা নিচু এলাকা হওয়ার কারণে কৃষিজমিগুলো অধিকাংশ সময় জলমগ্ন থাকে। এজন্য সেখানে দেখা দেয় দস্তার অভাব। সব মিলিয়ে দেশে এখন দস্তার ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫৫ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে, যা মোট জমির প্রায় ৩৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমাগত ফসল ফলানোর কারণে দেশের মাটিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে জৈব পদার্থ নেই। মাটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার না করায় উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। অপরিকল্পিত চাষাবাদ, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দূষণ, ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস এবং অপরিকল্পিতভাবে সারের ব্যবহারের কারণে মাটির উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ইটভাটার জন্য মাটির উপরিভাগের অংশ তুলে নেয়া ছাড়াও মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মৃত্তিকা এখন হুমকির মুখে রয়েছে। এসব কারণে মাটির স্বাস্থ্যহীনতায় এখন প্রতি বছর ফসল উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও এগ্রেরিয়ান রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. আবদুল হামিদ বলেন, জমির উর্বরতা শক্তি সংরক্ষণে অবহেলা খাদ্যনিরাপত্তায় বড় হুমকি হতে পারে। টেকসই উন্নয়নের স্বার্থেই প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ জরুরি। মনে রাখতে হবে শুধু টেকসই কৃষি উৎপাদনই নয়, সমগ্র জীবমণ্ডলের অস্তিত্বও এখন মাটির স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। এটা ঠিক, একই জমি বারবার ব্যবহারে মাটি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। এ ব্যাপারে পতিত রেখে জমির উর্বরতা শক্তি পুনরুদ্ধারে পরামর্শ দেয়া যেতে পারে ঠিকই। কিন্তু কোনো কৃষক জমি পতিত রাখার ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। ক্ষুদ্র কৃষকের খাদ্য ও আর্থিক প্রয়োজনের কারণেই তাকে উপর্যুপরি ফসল ফলাতে হচ্ছে। সমভূমিতে হোক বা পার্বত্যাঞ্চল—একই জমি বারবার চাষ করে কৃষি ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য কৃষক ও সরকারি পর্যায়ে অনুকূল নীতিকৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন। কৃষকরা সংঘবদ্ধ না হলে কার্যকরভাবে নীতিকৌশল বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন দরকার। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ১ কোটি ১৬ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে। তার মধ্যে খুব খারাপ (ভেরি সিভিয়ার) অবস্থায় রয়েছে দেশের ১১ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমি। খারাপ (সিভিয়ার) অবস্থায় আছে ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর, মাঝারি (মডারেট) ধরনের খারাপ অবস্থায় আছে ৩৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর ও হালকা (লাইট) খারাপ অবস্থায় আছে ৩৩ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমি। অন্যদিকে দেশে অম্লযুক্ত মৃত্তিকার উপস্থিতি রয়েছে প্রায় ৮৩ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর বা মোট জমির প্রায় ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশে। পাহাড়ে ভূমিক্ষয় প্রাপ্ত এলাকা রয়েছে ১৭ লাখ হেক্টর। উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ ২০ হাজার হেক্টর। খরাপ্রবণ এলাকার পরিমাণ প্রায় ১৪ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, অধিকাংশ কৃষকই প্রধান প্রধান ফসলের জন্য নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম সার ব্যবহার করেন। প্রশিক্ষণ ও জানাশোনার অভাবে সুষম সার ব্যবহার করেন খুব কমসংখ্যক কৃষক। অপরিমিত ও মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারে ফলনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এবং জমিতে ব্যবহূত সারের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময়ে জমিগুলো অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়বে এবং কৃষিতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। এজন্য রাসায়নিক ও জৈব সারের মিশ্র প্রয়োগের মাধ্যমে জমি থেকে ফসলের আহরিত খনিজ ও জৈব পদার্থের মাত্রা যদি ঠিকঠাক ধরে রাখা যায়, তাহলে মাটির উর্বরতা শক্তি ধরে রাখা সম্ভব। ঘাটতি কমানোর পাশাপাশি উর্বরতা শক্তি ধরে রাখতে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি জমি চাষে রোটেশন পদ্ধতি অনুসরণ ও কৃষি উপকরণ ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. কামারুজ্জামান বলেন, ‘সার্বিকভাবে দেশের মাটির স্বাস্থ্য ভালো নেই। মাটির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে। মাটির কোনো বিশ্রাম নেই। অতিব্যবহারে মাটির তিনটি চরিত্রই ক্ষতিগ্রস্ত। মাটি নিয়ে গবেষণার কমতি নেই। সে তুলনায় মাটি সংরক্ষণ বা মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদ্যোগ চোখে পড়ে না।  সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে ভৌত চরিত্র অনুযায়ী ৯ ধরনের মাটি (মৃত্তিকা দল) আছে। সব ধরনের মাটির রাসায়নিক গুণাবলি পরীক্ষা করেছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। তাতে দেখা গেছে, মাটিতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিকের পরিমাণ কম। দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মতো ৪৬০টি উপজেলার মাটির গুণাগুণ বা রাসায়নিকের তথ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে একই চিত্র পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রতিটি উপজেলার ভূমি ও মাটি ব্যবহার নির্দেশিকা তৈরি করেছে। কোন জমিতে কোন ফসলের জন্য কোন সার কী পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে, তার পরামর্শ আছে নির্দেশিকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ এনায়েত হোসেন বলেন, মাটির স্বাস্থ্য দিনে দিনে নষ্ট হচ্ছে। মাটির সুষ্ঠু ব্যবহারের আপাতত কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। তবে উপজেলাভিত্তিক এ নির্দেশিকা অনুসরণ করা যেতে পারে।

আলোকিত প্রতিদিন/ ৪ ডিসেম্বর ২৩/ এসবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here