আলোকিত ডেস্ক:
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে দেশের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের (এফডিআই) ওপর। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে বিনিয়োগ কমেছে ২৫ কোটি ডলার। গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরে এফডিআই এসেছে ৩১৯ কোটি ডলার। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বিনিয়োগ এসেছিল ৩৪৪ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্রমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই এসেছে ৩১৯ কোটি বা ৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট এফডিআই আসে ৩৪৪ কোটি বা ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। হিসাব মতে, গত অর্থবছর এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। যদিও ২০২১-২২ আগের অর্থবছর নিট এফডিআই বেড়েছিল রেকর্ড ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছরে এফডিআই আসে ২৫০ কোটি ৭০ লাখ বা ২৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে এফডিআই আসে ২৩৭ কোটি বা ২.৩৭ বিলিয়ন ডলার। সূত্র মতে, সাধারণত তিন পদ্ধতিতে বিদেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করে থাকে। পদ্ধতিগুলো হলো, নতুন পুঁজি তথা মূলধন হিসাবে, বিদ্যমান ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ করে এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে, যা ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২২-২৩ যুক্তরাজ্যের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছেন। এ সময়ে যুক্তরাজ্য থেকে প্রায় ৫৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ এসেছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৫৬ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৩ কোটি ৫৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ এসেছে নেদারল্যান্ডস থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে বিনিয়োগ এসেছিল ৩০ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। কোরিয়া থেকে এসেছে ২৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩১ কোটি ২৯ লাখ ডলার। ২৮ কোটি ৯১ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান চতুর্থ। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে বিনিয়োগ এসেছে ৩৫ কোটি ৪১ লাখ ডলার। এছাড়া সিঙ্গাপুর থেকে ১৯ কোটি ২০ লাখ ডলার, নরওয়ে থেকে ১৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার, হংকং থেকে ১৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলার, মাল্টা থেকে ১৭ কোটি ডলার, ভারত থেকে ১১ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ও মালয়েশিয়া থেকে ৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এদিকে গত অর্থবছরে সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে টেক্সটাইল তথা বস্ত্র খাতে, এর পরিমাণ ৬৬ কোটি ২২ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭০ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। এরপরেই আছে টেলিকমিউনিকেশন খাত। এ খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫১ কোটি ১৬ লাখ ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার এসেছে ব্যাংকিং খাতে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩১ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে এসেছে ৩২ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩৪ কোটি ৩২ লাখ ডলার। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ৩০ কোটি ডলার, খাদ্য খাতে ২৬ কোটি ৫৪ লাখ ডলার, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে ১২ কোটি ১১ লাখ ডলার, কেমিক্যাল ও ওষুধ খাতে ৭ কোটি ৯৫ লাখ ডলার, নির্মাণ খাতে ৭ কোটি ৬১ লাখ ডলার ও সার খাতে ৬ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। তথ্য মতে, বিদায়ী অর্থবছর দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে এফডিআই এসেছে মাত্র ৪ দশমিক ১৬ মিলিয়ন বা ৪১ লাখ ৬০ হাজার ডলার ও ইপিজেডে ৪০৬ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন বা ৪০ কোটি ৬৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার। আর ইপিজেড ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে অন্যান্য খাতে নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২ দশমিক ৭৮৫ বিলিয়ন বা ২৭৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। একদিকে রিজার্ভ থেকে অস্বাভাবিক ডলার বিক্রি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি বাড়াচ্ছে। অপরদিকে বিদেশি বিনিয়োগ, রপ্তানি টার্গেট পূরণ না হওয়া, রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবাহ দেশের অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, রেমিট্যান্স দেশে আসছে। তবে তা অবৈধ চ্যানেলে। ব্যাংকের মাধ্যমে আসছে না। যার অন্যতম কারণ ব্যাংকে ডলার রেট কম থাকা। ব্যাংকগুলো ডলার প্রতি কম টাকা দিয়ে থাকে হুন্ডির তুলনায়। যার ফলে হুন্ডিতেই প্রবাসীরা টাকা পাঠাচ্ছেন যার কারণে দেশের মানুষের এখনো ক্রয় ক্ষমতা স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি হুমকিতে পড়েছে। গেল সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ১৩৪ কোটি ডলারের কিছু বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। যা আগের বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২১ কোটি ডলার কম। এ অবস্থায় দেশের বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদেশি দাতা দেশগুলোর নানান প্রশ্ন, সুশাসনের ঘাটতি বিদেশি বিনিয়োগে বড় বাধা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য কর্মকর্তা ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ইপিজেড ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলতে এখনো গ্যাস, বিদ্যুতের সমস্যার সুরাহা করতে না পারা হতাশাজনক। একারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসছে না। এছাড়া সুশাসন, ব্যবসায়িক সুবিধা কোনোটিরই যথাযথ কার্যক্রম নেই। যার ফলে এদেশে বিনিয়োগ করতে একটি শঙ্কা কাজ করে। এসব বিষয়ে আমরা যতদ্রুত তাদের আশ্বস্ত করতে পারবো ততদ্রুত আমাদের বিনিয়োগ বাড়বে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রতিদ্বন্দ্বীরা কিন্তু থেমে নেই। ভিয়েতনাম প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশি দেশ শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানেও বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই কালক্ষেপণ না করেই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিডাকে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।’
আলোকিত প্রতিদিন/ ৯ ডিসেম্বর ২৩/ এসবি