টানা বৃষ্টিতে ক্ষতির মুখে তিন সবজির উৎপাদন

0
252

আলোকিত ডেস্ক:

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবে গত বুধবার থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হালকা, মাঝারি ও ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বর্তমানে মাঠে বোরো ধান, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, গম, সরিষা, শীতকালীন সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ডাল ও তেলবীজ রয়েছে। টানা বৃষ্টিতে বিভিন্ন স্থানে ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন আলু, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও বিভিন্ন শীতকালীন সবজি আবাদ করা কৃষকরা। সামনে পানি সরে গেলেও এসব ফসলে বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের রবি মৌসুমে ৪ লাখ ৬ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়েছে। আর ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সে অনুযায়ী, বেশির ভাগ জমিতে আলু ও পেঁয়াজ আবাদ করেছেন কৃষকরা। এছাড়া সাড়ে ৯ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা, প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে কাঁচামরিচ এবং ৫ লাখ হেক্টর জমিতে শীতকালীন শাকসবজির আবাদ করা হয়েছে।  বিভিন্ন জেলার কৃষকরা জানিয়েছেন, দুই-তিনদিনের বৃষ্টিতে আলু আবাদের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। লোকসান কমাতে অনেকে পানির নিচে থাকা জমি থেকে রোপণ করা বীজ আলু তুলে ফেলেছেন, যাতে সেগুলো পচে না যায়। বাড়িতে নিয়ে সেগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন তারা। এতে এ মৌসুমে আলুর উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।  দেশের উল্লেখযোগ্য আলু উৎপাদন হওয়া জেলার একটি মুন্সিগঞ্জ। টানা বৃষ্টিতে জেলাটিতে অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির আলু আক্রান্ত হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ৩৪ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৬ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ করেছেন কৃষকরা। বাকি থাকা বেশির ভাগ জমি আবাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।  মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে আছে বিস্তীর্ণ আলুর জমি। কৃষকরা নানাভাবে পানি সরানোর চেষ্টা করছেন।  জমির আইলে দাঁড়িয়ে তলিয়ে যাওয়া জমি দেখছিলেন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী গ্রামের কৃষক আবু নাছের মিয়া। তিনি বলেন, ‘এ বছর তিন কানি (৪২০ শতাংশ) জমিতে আলু আবাদ করেছিলাম। এখন সব পানির নিচে। সব বীজ পচে নষ্ট হয়ে যাবে। সরকার যদি আমাদের বীজ জোগাড় করে দিত আমরা টাকা দিয়ে কিনে নিতাম। তারপর আমরা জমিতে আবার আলু লাগাতে পারতাম। বৃষ্টিতে আমার সব শেষ হয়ে গেল। টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বলই এলাকায় তলিয়ে যাওয়া জমি থেকে বীজ আলু তুলে ফেলেছেন সিরাজ মাদবর। তিনি বলেন, ‘আলু লাগাইছিলাম সব তলায় গেছে। দুইটা বাক্স (হল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত বীজ) লাগাইছিলাম তাও তলায় গেল। এখন খুব কষ্ট করে কাদা ও পানি থেকে আলুর বীজ উঠাই ফেলছি যদি আবার লাগানো যায়। সদর উপজেলার কৃষক আরিফ দেওয়ান তার জমি থেকে থালা দিয়ে পাশের ডোবায় পানি সেঁচে ফেলছিলেন। তিনি বলেন, ‘গতকাল নালা কেটে দিয়েছিলাম। এখন জমির পাশের ডোবাও পানিতে ভরে গেছে। পানি যাওয়ার জায়গা নেই। তাই বাঁধ দিয়ে ডোবার মধ্যে পানি ফেলছি। দুদিন আগে হল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত ৫০ কেজি আলুর বাক্স ৯ হাজার ৩০০ টাকা ছিল। এখন সে বীজ ১৫ হাজার টাকা। তাও পাওয়া যাচ্ছে না। দুশ্চিন্তায় আছি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. মো. আব্দুল আজিজ বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। সরকারিভাবে আর্থিক প্রণোদনা কিংবা সহযোগিতা করা না গেলেও নিয়মিত পরামর্শ দেয়া হচ্ছে চাষীদের। এখনো মুন্সিগঞ্জের হিমাগারগুলোয় বেশকিছু আলু মজুদ আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তাছাড়া হল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত বীজও আছে। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত বীজ সংকট দেখা দেয় কিনা এটা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। ফরিদপুরের সালথা ও নগরকান্দায় বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও হালি পেঁয়াজের খেত। পেঁয়াজের ফলনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সেখানকার কৃষকরা। সালথা ও নগরকান্দা উপজেলার অন্তত ১০ জন চাষীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুড়িকাটা পেঁয়াজের বয়স হয়েছে ৪০-৪৫ দিন। এ পেঁয়াজ পরিপক্ব হতে ৯০ দিন সময় লাগে। পানি দ্রুত না নামলে ক্ষেতের পেঁয়াজ পচে যাবে। সালথার মাঝারদিয়া ইউনিয়নের কৃষক হাবিবর রহমান তিন বিঘা জমিতে হালি পেঁয়াজের চারা তৈরি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘জমি চাষ, সার-ওষুধ পানি ও শ্রমিকের পারিশ্রমিক মিলিয়ে এরই মধ্যে প্রায় ১৮-২০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। জমিতে এখন যেভাবে পানি উঠেছে এতে আর এ পেঁয়াজ বাঁচার সম্ভাবনা নেই। নতুন করে হালি লাগাতে আবার বিঘাপ্রতি ২০ হাজার টাকা খরচ বেড়ে গেল। জানতে চাইলে নগরকান্দা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা তিলক কুমার ঘোষ বলেন, ‘এ উপজেলায় চলতি বছর প্রায় আট হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করা হবে। এর মধ্যে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ৩৫০ হেক্টর এবং হালি পেঁয়াজ ৪০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। বৃষ্টি থামলে কীভাবে দ্রুত পানি সরানো যায়, এ বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হবে। বৃষ্টির কারণে কিছু পেঁয়াজের ক্ষতি হবে। এছাড়া পেঁয়াজের মৌসুম পিছিয়ে যাবে বৃষ্টির কারণে। যশোরে গতকাল ভোর ৬টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪৫ মিলিমিটার। এতে বেশির ভাগ জমিতে পানি জমেছে। যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি রবি মৌসুমে যশোরে ১ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে বোরোর বীজতলা, ৭৫০ হেক্টর জমিতে আলু, ১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে গম, ৩০ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে সরিষা, ১ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ, ৬০০ হেক্টর জমিতে রসুন এবং ৫৮৬ হেক্টর জমিতে মরিচ আবাদ করা হয়েছে।  জেলা সদরের চুড়ামনকাটি গ্রামের মাহবুবর রহমান সবজি ও কাঁচামরিচ আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টিতে খেতে পানি জমে গেছে। চেষ্টা করছি পানি সরানোর। ফসল নষ্ট হলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। ঝিকরগাছা উপজেলার মাটিকুমড়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমরা রসুন, মসুর ডাল ও পেঁয়াজ আবাদ করেছি। বৃষ্টিতে খেতে পানি জমে গেছে। ফসল অনেক নষ্ট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। যশোরে অনেক বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে ফসলের খেতে পানি জমে গেছে। বিশেষ করে পেঁয়াজ, রসুন ও কাঁচামরিচের ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের দেশে আবহাওয়ার আগাম সতর্কতার ক্ষেত্রে সক্ষমতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। যেন অঞ্চলভিত্তিক আলাদা পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, ‘এখন রবি মৌসুম চলছে। বোরো বীজতলায় কোনো ক্ষতি না হলেও অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে পানি জমলে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। আমরা কৃষকদের খেত থেকে পানি সরিয়ে নিতে পরামর্শ দিচ্ছি। গত মাসেই দেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি। প্রায় চার লাখ হেক্টর জমির ফসল এতে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ২৯ হাজার ৭১২ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে আমন ধান, বোরোর বীজতলা ও শীতকালীন শাকসবজির ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। এর ক্ষত না শুকাতেই মিগজাউমের প্রভাবে ফের টানা বৃষ্টিপাত কৃষিতে নতুন করে শঙ্কা তৈরি করেছে।  কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘এখন যে বৃষ্টি হলো তা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ কারণে পেঁয়াজ, আলু ও সরিষার কিছুটা ক্ষতি হবে। তবে তা খুব বেশি না। আমি নাটোরসহ কয়েকটি জেলা ঘুরেছি। দেখেছি পানি নেমে গেছে। কিছু নিচু জমিতে পানি জমেছে। আশা করি দ্রতই সেটা নেমে যাবে। আবার এ বৃষ্টির কারণে সরিষা আবাদ পিছিয়ে যাবে। বৃষ্টি ও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে রোগ-বালাই একটু বেড়ে যায়। এটা সবসময় ঝুঁকি থাকে। কারণ ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই চলতে হয়। তবে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তাতে সার্বিক উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে না।

আলোকিত প্রতিদিন/ ১০ ডিসেম্বর ২৩/ এসবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here