আলোকিত ডেস্ক:
শিকারি ও পাচারকারীদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের মায়াবি চিত্রা হরিণ। অভিযোগ উঠেছে, বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নানা কৌশলে সুন্দরবনে হরিণ শিকার করেন পাচারকারীরা। এসব হরিণের মাংস বন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করছেন শিকারিরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, বন বিভাগের নিয়মিত টহলেও কমছে না হরিণ শিকার। বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করেই হরিণ শিকার করছেন পাচারকারীরা। ফলে দিন দিন সুন্দরবনে হরিণ শিকার বাড়ছে। বিনিময়ে বন কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হরিণের মাংসসহ আর্থিক সুবিধা দিচ্ছেন শিকারিরা। তবে বিভিন্ন সময় হরিণের মাংস ধরা পড়লেও শিকারিরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। জানতে চাইলে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা এম কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের ভেতর আমাদের টহল অব্যাহত রয়েছে। তবে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি কম থাকায় শিকারিরা সহজেই বনের ভেতর প্রবেশ করতে পারে। যার ফলে এ সময় হরিণ শিকারও একটু বেড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনের মধ্যে যদি কেউ হরিণ শিকারি ধরিয়ে দিতে পারেন তাহলে তাকে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। আর বনের বাইরে ধরিয়ে দিতে পারলে রয়েছে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার। যা গেজেটে উল্লেখ রয়েছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন থেকে ৩০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের তেরকাটি খাল এলাকা থেকে এসব হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়। বন বিভাগের টহল টের পেয়ে হরিণ শিকারিরা বনের ভেতরে গা-ঢাকা দেন। তাই এ সময় শিকারিদের কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। তবে নৌকা ও বন বিভাগের দেওয়া একটি পাস উদ্ধার করেছে বন বিভাগের সদস্যরা।’ পরদিন ৫ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন থেকে ডিঙি নৌকা, হরিণ শিকারের ফাঁদসহ ২০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ইসহাকের ছিলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব হরণের মাংস জব্দ করা হয়। এ সময় কাউকে আটক করতে পারেননি বনরক্ষীরা। এর আগে গত ২৭ জানুয়ারি সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জ থেকে ১২ কেজি হরিণের মাংসসহ চারজনকে আটক করে বন বিভাগ। বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের টহল দলের সদস্যরা সুন্দরবনের বঙ্গবন্ধুর চর থেকে এসব হরিণের মাংস বিক্রির সময় তাদের হাতেনাতে আটক করেন। তারও আগে ২৩ জানুয়ারি বাগেরহাটের শরণখোলায় বসত বাড়ি থেকে হরিণের দুটি চামড়া জব্দ করে বন বিভাগ। শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের তানজির বয়াতির বাড়ি থেকে চামড়া দুটি উদ্ধার করা হয়। তবে এ সময় কাউকে আটক করতে পারেননি বনরক্ষীরা। আগের দিন ২২ জানুয়ারি সুন্দরবন থেকে হরিণের মাংসসহ দুই শিকারিকে আটক করে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ডিমেরচর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় ১৬ কেজি হরিণের মাংস, আটককৃতদের ব্যবহৃত ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ১৫০টি ফাঁদ ও ২৫০ ফুট নাইলন সুতা জব্দ করেন বনরক্ষীরা। এরও আগে ১৭ জানুয়ারি সুন্দরবন থেকে হরিণের মাংসসহ চার জেলেকে আটক করে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের দুবলারচর শুঁটকি পল্লী সংলগ্ন নাড়িকেলবাড়িয়ার চর থেকে সাড়ে চার কেজি হরিণের মাংস জব্দসহ তাদের আটক করা হয়। ২০২২ সালেও সুন্দরবনের হরিণ শিকারিরা ছিল ব্যাপক তৎপর। প্রায় বছরজুড়েই হরিণ নিধনের খবর ছিল। জানা গেছে, সুন্দরবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাণী হচ্ছে চিত্রা হরিণ। বর্তমানে এই হরিণের সংখ্যা দেড় লাখের বেশি। ফলে সুন্দরবনে যত্রতত্র হরিণের দেখা মেলে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে বনের বিভিন্ন স্থানে হরিণের দেখা পাওয়া যায়। আর এই সুযোগটিই বেশি কাজে লাগায় শিকারিরা। কারণ, বর্ষা মৌসুমে সুন্দরবনে প্রবেশ কিছুটা কষ্টসাধ্য হলেও শুষ্ক মৌসুমে শিকারিরা নানা কৌশলে বনে ঠুকে পড়ে। অনেক শিকারি মাছ ধরার পারমিট নিয়ে রাতের আঁধারে গোপনে বনে প্রবেশ করে। বনের যে সব স্থানে হরিণের বিচরণ বেশি সে সব জায়গায় নানা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করা হয়। শিকারিদের ফাঁদের মধ্যে রয়েছে-নাইলনের জাল, বিষ মাখানো স্প্রিং, কলার সঙ্গে বড়শি, চেতনানাশক ওষুধ ও তীর অথবা গুলি। এসব দিয়েই তারা হরিণ শিকার করেন। হরিণ ধরার ফাঁদ বেশি ব্যবহার হচ্ছে হিরণ পয়েন্ট, দুবলারচর, বঙ্গবন্ধুর চর, কটকা, তালপট্টি, কচিখালি, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালি এলাকায়। চোরা শিকারিরা বনের ভেতর থেকে হরিণ শিকার করে লোকালয়ে থাকা সহযোগীদের হাতে পৌঁছে দেয়। পরে কয়েক হাতবদল হয়ে হরিণ পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। হরিণের মাংস চড়া দামে বিক্রি হয়। প্রতি কেজি হরিণের মাংসের দাম পড়ে এক হাজার ৫০০ টাকা। আর আস্ত একটি জীবিত হরিণের দাম চাওয়া হয় ১৫ হাজার টাকা। ক্রেতারাও অনেক সময় প্রতারণা ভেবে হরিণের মাংস কিনতে চান না। তাই তাদের প্রমাণ দেখাতে চোরা শিকারিরা জীবন্ত হরিণ লোকালয়ে এনে জবাই করে থাকেন। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, ‘সীমিত লোকবল ও জলযান নিয়ে সুন্দরবনের হরিণ রক্ষায় চেষ্টা করা হচ্ছে। জনবলের অভাবে হরিণ শিকারিদের ধরতে প্রতি পয়েন্টে টহল দেওয়া যাচ্ছে না। তবুও আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আলোকিত প্রতিদিন/ ১৭ ডিসেম্বর ২৩/ এসবি