মনিরুল হকের গল্প: এক নিভৃত বিকালের চোরের কাহিনী

0
502
ফাইল ছবি: মনিরুল হক
ফাইল ছবি: মনিরুল হক

এক নিভৃত বিকালের চোরের কাহিনী
মনিরুল হক

মাঝে মাঝে বিকাল বেলা একা একা হেটে হেটে নির্জন নিভৃতে কোনো স্হান পেলে বসে যাই। চারপাশের লোকজনের হাঁটা চলা দেখি গাছপালা দেখি পাখিদের কিচির মিচির শুনি।সময়টা ভালো কেটে যায়। বেশ কয়েকদিন আগে আগারগাঁওয়ের এক প্রশস্ত সড়কের পাশে বসে বসে চা খাচ্ছি। একটু দুরে দেখি একটি বৃদ্ধ লোক উশকো খুশকো চুল বসে বসে আমার চা খাওয়া দেখছে।কাপর চোপর ছিন্ন ভিন্ন মলিন। চোখাচুখি হওয়ায় সে আমার পাশে এসে বসে বলল স্যার আমায় এক কাপ চা খাওয়ান।চিনি না জানি না পরিচয় নাই এককম কেউকে চা খাওয়ানোর অনুরোধ এই প্রথম পেলাম। তাই আগ্রহ নিয়ে পেছনের টং ঘরে একটা চায়ের অর্ডার দেই। যথাসময় চা আসলে জিজ্ঞাস করি আপনার পরিচয় বলুন।সে বলে আমার পরিচয় দেওয়ার মতন কিছু নাই তবে আমার এলাকায় সবাই আমাকে মফিজ চোর নামেই চিনে। আমি বললাম বিষয়টা একটু খুলে বলুন। সে বলতে শুরু করল:
আমার বাবা গ্রামের বাড়িতে নানা ধরনের দিনমুজুরের কাম কাইজ করতো। আমরা খুবই দরিদ্র ছিলাম। আমার বয়স যখন সাত আট বছর হবে তখন আমার বাপ কি এক অসুখে মারা যায়। আমার মা এ বাড়ি ও বাড়ি করে কোনো মতে দুটো খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত করতো।একদিন সে আর ঘড়ে ফিরলনা। আমি ছেলে মানুষ আশপাশ খুঁজে ফিরে কোথাও তাকে না পেয়ে কান্না কাটি করে ঘড়ে ফিরলাম।আমার এক বিধবা ফুপু ছিল। সে ও চরম দরিদ্র ছিল। তার ছেলেরা তার কোনো খোঁজ খবর নিতনা। সে চেয়ে চিনতে যা জোগার করতে পারতো তাই নিজে খেত আর আমাকে খাওয়াতো। কিছুদিন পরে খবর পেলাম আমার মা আবার বিয়ে করে ঘড় সংসার শুরু করেছে।সারাদিন ঘোরাঘুরি করি মাথায় শুধু খাওয়ার চিন্তা।ক্ষুধায় পেট সব সময় চো চো করতো। কোথাও কাজের কথা বললে সবাই পোলাপান বলে নিতনা তাছাড়া বড়রাই কাজের তালাশে ব্যাতি ব্যস্ত থাকতো। কারো কারো বাগানে ফলটল থাকলে চুরি করতাম। মাঝে মধ্যে ধরা পড়লে কিল গুতা খাইতাম। ক্রমশ চুরির কাজটাই সহজ মনে হতো। বাপ থাকতে তিন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলাম। স্কুলে পোলাপান দেখলেই বলে কিরে মফিজ চোরা চুরি করতে কোথায় যাস? এই অবস্হায় সব সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেস্টা করতাম।কিন্তু একদিন একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সেদিন ফুফুর জ্বরের কারনে কোনো খাওয়া দাওয়ার জোগার না হওয়ায় খুবই পেরেশানির মধ্যে ছিলাম উপরন্তু ফুফুও খাওয়ার জন্য কাতরাতে ছিল। অনেক ভেবে চিন্তে কারো বাড়িতে চুরি করার জন্য রাতের গভীরে বের হলাম।আমাদের দু বাড়ির পরের বাড়ি বেশ অবস্হা সম্পন।চারিদিক সুনসান নিশ্চুপ। আমার টারগেট পাকের ঘড় থেকে ভাত চুরি করা। পাকের ঘড়ের শিকল খুলে তড়িঘড়ি করে ভাত আর সালুনের পাতিল নিতে গিয়ে পাতিলে পাতিলে ঠোকোরের আওয়াজে কে কে করে উঠোনে এসে সবাই হাতে নাতে ধরলো।আমার কোনো কথাই কেউ শুনল না। এমন পিটানি দিল যে হাইগা মুইতা দিলাম।এর পরের কাহিনী অনেক।পাশের গ্রামের এক লোক আমাকে তার বাড়িতে গরু ছাগল পালনের জন্য নিতে চাইল। আমি রাজি হয়ে তার সাথে গেলাম।পরে জানতে পারলাম যে সে ও আসলে একজন চোর।এরপর আর নিজ বাড়িতে যাই নাই।এর ভেতর অনেক ছেচা গুতা খাইয়া জুয়ান হইলাম। ঐ চোরের সহযোগিতায় ঢাকা আইলাম। গাবতলীতে পকেটমার দলের সাথে সংযুক্ত হইলাম।এখানেও ধরা পইরা অনেক প্যাদানি গুতানি এবং থানা পুলিশের ঝামেলা পোহাতে পোহাতে সব কিছুর উপর একটা তিক্ততা এসে গেল। এক রিক্সা গ্যারেজে ঘুমাইতাম সেইখানে আমার বইসি এক রিক্সা চালকের সাথে পরিচয় হল।সে পুরান পেপার জোগার করে পড়তো।মাঝে মাঝে খবর পড়িয়া সে আমাকে শুনাইতো।পরে জানতে পারলাম সে মেট্রিক পাশ করে কোথাওকিছু না করতে পেরে রিক্সা চালাতে শুরু করল।তার সহযোগিতায় আমিও রিক্সা চালানো শিখে একবেলা রিক্সা চালাইতাম আরেক বেলা পকেট মারতাম।
একদিন একজনের পকেট কাইটা বেশ ভালো মাল পাইয়া হোটেলে চা খাইতে ঢুইকাই পুলিশের হাতে ধরা খাইলাম। হাতে নাতে ধরা। টাকা যেমন আছে তেমন ছিল সাথে একখান কাগজও। নথিপত্র সহ ধরা অস্বীকার করার কোনো রাস্তা নাই। ভীষণ মারপিট করল ভাবলাম টাকা পাইছে যখন ছাইড়া দিব কিন্তু না থানায় নিয়া গারদে ঢুকাইল। রিক্সা গ্যারেজের দোস্ত সুমন খবর পাইয়া টাকা পয়সা দিয়া পরের দিন ছাড়াইয়া আনল।এই ভাবে দিনে দিনে বৃদ্ধ হইলাম। এখন রিক্সা চালাইতে পারিনা। বিবাহ সাদি করি নাই। চোরের কাছে কেউ মাইয়া বিয়া দেয় না।পোলাপান নাই।মফিজ চোরের তকমা নিয়া আর গ্রামে যাই নাই। ফুফু মইরা গেছে বহুত আগে।
সুমনের পড়া পত্রিকার খবর শুনতে শুনতে দেশের অনেক খবর জানতে পারি। প্রায়ই শুনি মন্ত্রী,এমপি রাজনীতিবিদ,সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী,পুলিশ,ব্যবসায়ী ব্যাংকের মালিক ও হোমরা চোমরা সবাই টাকা চুরি করে দেশে বিদেশে অঢেল সম্পতির মালিক হয়েছে এবং অনেক আরাম আয়েসে দিন গুজরান করছে।কানাডায় বেগম পাড়ায় এরকম অনেক বাংলাদেশী বসবাস করছে।
জীবন বাচানোর জন্য আমার মতন একজন সাধারণ মানুষের বিপদে কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে নাই। হায় জীবন!

 

আলোকিত প্রতিদিন/ ২২ ডিসেম্বর ২০২৩/ দ ম দ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here