নারায়ণগঞ্জে চার বছরে গ্যাসের আগুনে ১৯৮ জনের প্রাণহানি

0
176

আলোকিত ডেস্ক:

নারায়ণগঞ্জে গ্যাসলাইন লিকেজের কারণে গত চার বছরে ২৬৫টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১৯৮ জন। আহত হয়েছে চার শতাধিক মানুষ। গ্রাহকদের অসচেতনতা, গ্যাসলাইনের অব্যবস্থাপনা, পুরনো পাইপ দিয়ে মূল সঞ্চালন লাইন থেকে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ এবং অবৈধ সংযোগকেই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবৈধ সংযোগ অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ালেও তা বন্ধ করতে পারেনি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। শুধু নারায়ণগঞ্জ শহর ও আশপাশের উপজেলায় কমপক্ষে ২০-৩০ হাজার অবৈধ সংযোগ রয়েছে বলে দাবি করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দুর্ঘটনা রোধে গ্যাস ব্যবহারে গ্রাহককে আরো সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপরে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড আঞ্চলিক বিভাগের জিএম প্রকৌশলী মামুনুর রশিদ বলেন, ‘গ্যাস লিকেজ নয়, ব্যবহারকারীর অসচেতনার কারণেই ঘটছে দুর্ঘটনা। গ্যাস ব্যবহারে গ্রাহককে সচেতন হতে হবে। নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় গ্যাস লাইনে লিকেজ ছিল সেগুলো চিহ্নিত করে মেরামত করা হয়েছে। কোনো জায়গায় পাইপ-লাইনে ত্রুটির খবর পেলেই আমাদের টিম তা দ্রুত মেরামত করে। চুলা জ্বালানোর আগে ঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখতে হবে। রান্নাঘরে যাতে গ্যাস জমে থাকতে না পারে সেজন্য আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতি তিন থেকে ছয় মাস পরপর গ্যাসের পাইপ বা চুলার সংযোগ পাইপ পরীক্ষা করতে হবে। অবৈধ সংযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ শহরসহ রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ ও আড়াইহাজার উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগ রয়েছে। সেগুলো ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও জরিমানা ও কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে। তিতাস গ্যাস, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্যাসলাইন লিকেজের কারণে ২৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। দগ্ধ হয়েছে অর্ধশত মানুষ। ২০২২ সালে ১০৪টি বিস্ফোরণের মধ্যে শুধু গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে ৬৯টি। এতে প্রাণ গেছে ৬০ জনের। ২০২১ সালে ১১৪টি বিস্ফোরণের মধ্যে গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ ঘটেছিল ৯৬টি। এতে প্রাণ হারায় ৫৩ জন। এছাড়া ২০২০ সালে ১০৬টি বিস্ফোরণের মধ্যে গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ ঘটেছিল ৭৬টি। এসব দুর্ঘটনায় ৭০ জন নিহত হয়েছে। গত চার বছরে এসব অগ্নিদুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা ছিল চার শতাধিক। একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলেও সচেতন হচ্ছেন না গ্রাহক। পাশাপাশি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের অবহেলা রয়েছে বলে মনে করে সচেতন নাগরিক। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগের ছড়াছড়ি। শহরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা বিশেষ করে সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, বন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়িসহ হোটেল রেস্তোরাঁ ও কারখানায় হাজার হাজার অবৈধ গ্যাসের সংযোগ রয়েছে। তিতাস গ্যাসের কতিপয় কর্মচারী, ঠিকাদার এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় এসব সংযোগ রাতের আঁধারে নেয়া হয়েছে। কোনো কোনো মাটি খুঁড়ে নিচ দিয়ে প্লাস্টিকের পাইপে সংযোগ নেয়া হয়েছে। এসব সংযোগ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও কয়েকদিন পর আবার রাতের আঁধারে সংযোগ নেয়া হয়।’ এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি রফিউর রাব্বি বলেন, ‘গ্যাসের লিকেজে একের পর এক প্রাণহানির জন্য মূলত দায়ী তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি গ্রাহকের উদাসীনতা ও ব্যবহারের নিয়ম না মানার করণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। তিতাস গ্যাসের নারায়ণগঞ্জে যে সরবরাহ লাইন রয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ। অভিযোগ করলেও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ মেরামতের উদ্যোগ নেয় না।  যখন বিস্ফোরণে প্রাণহানি ঘটে, তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তদন্ত করে আবার কয়েকদিন গেলেই আগের পর্যায়ে চলে যায়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তিতাস কর্তৃপক্ষ দায় এড়ানোর জন্য গ্রাহকের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ২২ সেপ্টেম্বর আড়াইহাজারের কলেজপাড়ার একটি  বাড়িতে  গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে চারজন দগ্ধ হন। শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন তারা সবাই মারা যান। ১৯ আগস্ট ফতুল্লার কায়েমপুর বটতলা এলাকায় গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে তিনজন আহত হন। পরবর্তী সময়ে তিনজনই মারা যান। ২৯ জুলাই ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কের পাশে ভোলাইল স্বপন মিয়ার বাড়ির নিচ তলায় বিকট শব্দে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরণ হয়। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ১৫ জনকে উদ্ধার করে। অবশ্য তাদের মধ্যে তিনজন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গ্যাস বিস্ফোরণে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের বাইতুস সালাত জামে মসজিদে। বিস্ফোরণে ৩৪ জন প্রাণ হারান। নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি বছরই নারায়ণগঞ্জে গ্যাস লাইনের লিকেজ বা গ্যাস সিলিন্ডার লাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে প্রাণহানি ঘটছে। মূলত গ্রাহকের সচেতনতার অভাব, লিকেজ চোখে পড়লেও দ্রুত মেরামত না করা, গ্যাসের চাপ কম থাকলে চুলার চাবি বন্ধ না করায় আবদ্ধ ঘরে গ্যাস জমে থাকে। সে সময় ম্যাচের কাঠি জ্বালালেই বিস্ফোরণ ঘটে। এছাড়া অবৈধ সংযোগে নিম্নমানের পাইপ ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণেও বিস্ফোরণ ঘটছে বলে তদন্তে দেখা গেছে।

আলোকিত প্রতিদিন/ ২৪ ডিসেম্বর ২৩/ এসবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here