সবুজ সরকার:
“সংসার সামলে কর্মক্ষেত্রে তাদের সফল্যও নজরকাড়া। সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছেন এসব নারী কর্মকর্তা” আজ ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। অগ্রযাত্রায় নারীর অবদান এখন আর কোনো মিথ্যা নয়। সারাদেশের মতো টাঙ্গাইলেও বিভিন্ন দপ্তরে সমানতালে কাজ করছেন নারীরা। বিশেষ করে জেলায় সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলাচ্ছেন তারা।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ, শিক্ষা অফিস, স্বাস্থ্য, কৃষি, নির্বাচন অফিস, মেয়র, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউএনও, এসিল্যান্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ৮০ জন নারী সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। সংসার সামলে কর্মক্ষেত্রে তাদের সফল্যও নজরকাড়া। সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছেন এসব নারী কর্মকর্তা।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন ১১ জন নারী কর্মকর্তা। তারা হলেন- অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) নাফিসা আক্তার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আইরিন আক্তার, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (আরএম শাখা) নাজিয়া হোসেন, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর নুশরাত আরা খানম, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (স্থানীয় সরকার শাখা) নাহিয়ান নূরেন, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (এলএ শাখা) ফারজানা আক্তার, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (তথ্য ও অভিযোগ শাখা, ফরম্স এন্ড স্টেশনারি) সাদিয়া আকতার, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (ভিপি সেল) সিনথিয়া হোসেন, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (আইসিটি শাখা) সাবরিন আক্তার, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (সাধারণ শাখা) জান্নাতুল নাঈম বিনতে আজিজ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এসএ শাখা) রিতা সুলতানা।
জেলার ১২ উপজেলায় তিনজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) দায়িত্ব পালন করছেন। তারা হলেন- মির্জাপুর উপজেলার শাকিলা বিনতে মতিন, দেলদুয়ারে শাকিলা পারভীন এবং গোপালপুর উপজেলায় সৈয়দা ইয়াসমিন সুলতানা।
টাঙ্গাইলের বিভিন্ন প্রশাসনিক এলাকায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে ৩ জন নারী সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। তারা হলেন, ধনবাড়ীতে ফারাহ ফাতেহা তাকমিলা, বাসাইলে নূরী তাসমিন ঊর্মি এবং ভূঞাপুরে ফাহিমা বিনতে আখতার।
টাঙ্গাইলের মধুপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফারহানা আফরোজ জেমি।
টাঙ্গাইলের স্বাস্থ্য বিভাগে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন- বাসাইলে শার্লী হামিদ ও ধনবাড়ীতে ডা. শাহানাজ সুলতানা। এছাড়া, সিভিল সার্জন অফিসের জেলা পাবলিক হেলথ নার্স হিসেবে কর্মরত মিলি চন্দ।
জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রয়েছেন কণিকা মল্লিক। এছাড়া আরও ৯ জন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা হলেন, দেলদুয়ার উপজেলায় দেওয়ান খায়রুন নাহার, নাগরপুরে শাহীন রুবা আক্তার, মির্জাপুরে শারমিন সিদ্দিকা, গোপালপুরে মাহমুদা খাতুন, মধুপুরে শারমিন সুলতানা সুমি, ঘাটাইলে তাপসী শীল, ভূঞাপুরে আমেনা বেগম, কালিহাতীতে শিল্পী দে এবং সখীপুর উপজেলায় ফিরোজা আক্তার।
জেলার একমাত্র ও প্রথম নারী মেয়র হিসেব দায়িত্ব পালন করছেন মির্জাপুরের সালমা আক্তার। ভূঞাপুরে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন নার্গিস বেগম।
জেলায় শিক্ষা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা সাতজন হলেন- জেলা শিক্ষা অফিসার রেবেকা সুলতানা, শিক্ষা অফিসের সহকারী পরিদর্শক বীথি খান, মির্জাপুর উপজেলা সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শাহনাজ পারভীন, ভূঞাপুরে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার তাহমিনা আক্তার, গোপালপুরে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার কামরুন নাহার, দেলদুয়ারে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মোসাম্মৎ খাদিজা এবং কালিহাতীতে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার জুলিয়া আক্তার। জেলা তথ্য অফিসে সিনিয়র তথ্য অফিসারের দায়িত্বে আছেন তাসলীমা জান্নাত। জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক হিসেবে আছেন আইভি ইয়াছমিন।
প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে দায়িত্বরত পাঁচজন নারী কর্মকর্তা হলেন- সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট খালেদা আক্তার বানু, ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ) রাজিয়া সুলতানা, ইন্সট্রাক্টর (বিজ্ঞান) সাদিয়া খন্দকার, ইন্সট্রাক্টর (কৃষি) নূসরাত শারমিন এবং ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ) কনিকা আক্তার। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কৃষি অফিসার হিসেবে পাঁচজন নারী রয়েছেন। তারা হলেন- গোপালপুরে শামিমা আক্তার, সদরে রুমানা আক্তার, সখীপুরে নিয়ন্তা বর্মণ, ঘাটাইলে বিলশাদ জাহান এবং কালিহাতীতে ফারাহানা মামুন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের সরেজমিন গবেষণা বিভাগে কাজ করছেন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কাকলী রায় এবং বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তাহেরা তাসমিমা। জেলার মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট আঞ্চলিক কার্যালয়ে দুই জন নারী দায়িত্ব পালন করছেন। তারা হলেন- প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহসানা আক্তার এবং বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জয়শ্রী জোয়ারদার। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক গবেষণাগার কার্যালয়ে তিন নারী দায়িত্ব পালন করছেন। তারা হলেন- ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আইরিন সুলতানা, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আর্জিনা হক এবং বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ইফফাত জাহান।
টাঙ্গাইল কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইন্সট্রাক্টর অফিসে কাজ করছেন- সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর সুলতানা এবং ইন্সট্রাক্টর লায়লা আক্তার। জেলা যুব উন্নয়ন অধিপ্তরের দুইজন নারী দায়িত্ব পালন করছেন। তারা হলেন- যুব উন্নয়ন অধিপ্তরের উপপরিচালক ফাতেমা বেগম এবং প্রশিক্ষক স্বপনা ফারহানা। বিসিক জেলা কার্যালয়ে কাজ করছেন ভারপ্রাপ্ত সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহনাজ বেগম এবং ভারপ্রাপ্ত জরিপ ও তথ্য কর্মকর্তা আছমা আকতার। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে শরিফা বেগম, ভূঞাপুরে নাজমা সুলতানা এবং মধুপুরে ফারহানা শিরিন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে। এছাড়াও দেলদুয়ারে সহকারী উপজেলা নির্বাচন অফিসার সাবরিনা এবং নাগরপুরে সহকারী উপজেলা নির্বাচন অফিসার সাবরিনা দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়াও জেলা সঞ্চয় অফিসের সহকারী পরিচালক ফারহানা পারভীন, জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে থেরিওজেনোলজিস্ট ডা. সূচনা সরকার, জেলা মৎস্য অফিসের সহকারী পরিচালক জান্নাতুন শাহীন, সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা (রুটিন দায়িত্ব) ফারজানা খান, বিএডিসি (ক্ষুদ্র সেচ) অফিসের টাঙ্গাইল সদর ইউনিটের উপসহকারী প্রকৌশলী আসমা আক্তার, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রাক্কলনিক শামীমা আকতার, সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) উপতত্বাবধায়ক তানিয়া আক্তার, জেলা কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক (স্বাস্থ্য) তাহেরা আক্তার দোলন, পাসর্পোট অফিসের সহকারী পরিচালক জেবুন্নাহার পারভীন, টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তানজিনা তাসমিনা তোহফা।
উপজেলার নারী কর্মকর্তারা জানান, তারা দেশের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক সমস্যা দূরীকরণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। মাঠ প্রশাসনের কাজের সমন্বয় ও তদারকি, জেলার সঙ্গে সমন্বয় করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছেন তারা। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন, সরকারের স্থায়ী আশ্রয়ণ, আদর্শ গ্রাম, আবাসন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং অসহায় ও সুস্থ মানুষদের সহায়তায় কাজ করেন। একই সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন।
দেলদুয়ার উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা দেওয়ান খায়রুন নাহার বলেন, “মাঠপর্যায়ে আমাদের কাজের পরিধি বেশি। একদিকে যেমন সংসারের দায়িত্ব পালন করতে হয়, অন্যদিকে সঠিকভাবে যথাসময়ে অফিসেরও দায়িত্ব পালন করছি। বিশেষ করে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করে থাকি।” জেলা শিক্ষা অফিসার রেবেকা সুলতানা বলেন, “সমাজে এখনো নারীরা পিছিয়ে রয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সমান অধিকার দিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে বাঁধা-বিপত্তি আসবেই। আমরা পরিবেশ পরিস্থিতি অনুয়ায়ী সেগুলো মোকাবেলা করে কাজ করছি। পাশাপাশি সবার সহযোগিতা নিয়েই কাজ করছি।”
মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাকিলা বিনতে মতিন বলেন, “নারী হিসেবে কাজ করতে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবন্ধকতা পাইনি। আমি মনে করি সবাই কর্মকর্তা, নারী কিংবা পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিভিন্ন জটিল কাজগুলো করে থাকি। রাতেও আমি ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়েছি। পরিবার থেকে আমাকে সব সময়ই সার্পোট করে।” নারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “প্রথমে নিজেকে ভালোবাসতে হবে এবং স্বাবলম্বী হতে হবে।”অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) নাফিসা আক্তার বলেন, “নারী-পুরুষের সমান অধিকার। সবক্ষেত্রেই নারীদের অবদান এখন বেশি। নারীরা এখন সব জায়গায় এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে শরিক হয়ে আমরা মেয়েরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যাচ্ছি। একজন নারী সঠিকভাবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। কাজ করতে গেলে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ থাকে। সে চ্যালেঞ্জগুলো আমরা মোকাবিলা করি। চ্যালেঞ্জিং পেশা এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে সফল হয়েছেন অসংখ্য নারী।” টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বলেন, “জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত নারীরা যথাযথ দক্ষতা এবং পেশাগত জ্ঞান নিয়ে জনসেবামূলক কাজ করছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও নারীরা পিছিয়ে নেই। নারী কর্মকর্তরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নারীরা ভূমিকা রাখছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নারী কর্মকর্তাদের উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
আলোকিত প্রতিদিন/৮ মার্চ-২৪ /মওম