শেখ মুহাম্মদ ওয়ালি উল্লাহ
পবিত্র কালামুল্লায় মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত বর্ণনা করেন- হে ইমানদারগণ তোমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেরূপ ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্বর্তীদের উপর। যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো (আল কুরআন)।
আর এই রমজান মাসের ৩০ দিনকে ভাগ করা হয়েছে তিন ভাগে। দশদিন দশদিন করে অর্থাৎ রহমত, বরকত ও মাগফেরাত। এ মাসের শেষ দশ দিনে রয়েছে এক মহিমান্বিত রাত, যার ফজিলত মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ কুরআনে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা অবতীর্ণ করেন- যার নাম সূরাতুল ক্কদর অর্থাৎ মর্যাদার সূরা বা মহিমান্বিত সূরা ইত্যাদি।
লাইলাতুল ক্কদর এমন এক রাত যে রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন লাউহে মাহফুজ থেকে সমগ্র কুরআন প্রথমে আসমানে নাযিল করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ ২৩ বছরে রাসুলল্লাহ (সা.) এর উপর জিব্রাইলল (আ.) মাধ্যমে অবতীর্ণ করেন। এমনকি এক বর্ণনায় আছে রাসুল (সা.) এর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম অহি এ রাতেই শুরু হয়। এ রাত শান্তি বর্ষণের রাত, বান্দাকে ক্ষমা করার রাত, এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল ক্বদরের রাতে নফল নামাজ আদায় করবে আল্লাহ ঐ ব্যক্তির পূর্ববর্তী জীবনে ঘটে যাওয়া গুণাহগুলো ক্ষমা করে দিবেন।
এই রাতে হযরত জিব্রাইল (আ.)-এর নেতৃত্বে পৃথিবীতে অসংখ্য ফেরেশতা অবতীর্ণ হন এবং মুক্তিকামি বান্দাদের হয়ে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য ফরিয়াদ জানান। পাশাপাশি আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় রহমত বরকত বর্ষণ করেন।
এ রাত এমন এক রাত যা পূর্ববর্তী কোনো নবী বা রাসুলের উম্মতকে দান করা হয়নি। কেবলমাত্র মুহাম্মদ (সা.)-এর উসিলায় উনার মর্যাদার কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে তথা মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতদেরকে দান করেছেন। যাতে এই উম্মতের হায়াতের জিন্দেগী ছোট হওয়া সত্ত্বেও হায়াৎ বেশি পাওয়া অন্য নবী রাসুলের উম্মত থেকে আমলের দিক দিয়ে পিছনে না পড়ে। বলা যায় লাইলাতুল ক্কদর মহান রবের পক্ষ থেকে উম্মতের জন্য এক মহান করুণা।
যে মুসলমান ক্কদরের রাতে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে কাটাবে সে যেনো হাজার রাতের ইবাদত বন্দেগীতে কাটালো (সুবহান আল্লাহ)। সূরা ক্কদরে হাজার মাস বলে আল্লাহ সীমাবদ্ধ করেন নাই বরং হাজার মাসের চাইতেও উত্তম বলেছেন। আর হাজার মাস যদি আমরা হিসাব করি তাহলে এক রাত সমান ৮৩ বছর হয়। এরূপভাবে যদি কোনো মুসলিম ব্যক্তি জীবনে গড়ে ৩০/৪০টি লাইলাতুল ক্কদর পেয়ে যায় তাহলে সে ব্যক্তি গড়ে ২/৩ হাজার বছর একাধারে এবাদত করার সওয়াব পেয়ে যায়। আর এটা পাওয়া খুব স্বাভাবিক যদি আমাদের অন্তরে সে চেষ্টা থাকে। তাই আসুন আমরা আল্লাহর দেয়া এই ক্কদরের রাতের মর্যাদা রক্ষা করি এবং এর সঠিক হক আদাই করি। আল্লাহর নৈকট্যে সকলে অন্তর্ভূক্ত হই।
আর লাইলাতুল ক্কদর তালাশ করতে হবে রমজানের শেষ দশ দিনের মধ্যে। বিশেষত বেজোড় সংখ্যক তারিখের রাতগুলোর মধ্যে। এখন শেষ দশ দিনের কোন রাতে লাইলাতুল ক্কদর হতে পারে এ ব্যাপারে সাহাবী উবায় ইবনে কাব (রা.) বলেন আল্লাহর শপথ রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে ক্কদরের রাত হিসেবে রমজানের ২৭ তারিখ এবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
সাতাইশ তারিখ লাইলাতুল ক্কদর হওয়ার ব্যাপারে হযরত ইমামে আজম আবু হানিফা (র.) যুক্তি দেখান সূরাতুল ক্কদরে ‘লাইলাতুল ক্কদর’ বাক্যটি তিনবার বর্ণনা করেছেন। আর লাইলাতুল ক্কদর বাক্যটি লিখতে মোট আরবি বর্ণ লাগে ৯টি। আর এই ৯-কে ৩ দ্বারা গুণ করলে হয় ২৭। অতএব লাইলাতুল ক্কদর রমজানের ২৭ তারিখ বা ছাব্বিশে রমজানের দিবাগত রাতে হওয়াই যুক্তিযুক্ত। এ ব্যাপারে সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন যে রাসুল বলেছেন যে ব্যক্তি ক্কদরের রাত অর্জন করতে ইচ্ছুক সে যেনো রমজানের ২৭ তম রাতে অনুসন্ধান করে। এ লাইলাতুল ক্কদর রাতটা চিহ্নিত করার জন্য রয়েছে কিছু আলামত বা চিহ্ন। যেমন-
- রাতটা অন্য রাতের চেয়ে আলাদা মনে হবে।
- মৃদু বাতাস প্রবাহমান থাকবে, খুব গরমও নয়; আবার খুব ঠাণ্ডাও নয়। সের্বাপরি একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব অনুভব হবে।
- অন্য সময়ের চেয়ে এ রাতে এবাদতে বেশি মজা পাওয়া যাবে।
- রাতটা খুব বেশি অন্ধকার হবে না।
- হালকা বৃষ্টিও হতে পারে।
সর্বোপরি কথা হলো রমজান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতসহ সকল রাতগুলোকে সমান গুরুত্ব দিয়ে এবাদত বন্দেগী, জিকির আজকার, দান সদকা, কুরআন তেলাওয়াত, তাহাজ্জুতসহ যতো বেশি ফরজের পাশাপাশি নফল এবাদত করা যায় ততই উত্তম। যাতে কোনো ক্রমেই আমরা সবে ক্কদরের রাতের ফজিলত থেকে আমরা বঞ্চিত না হই।
ক্কদরের নামাজ বলে আমাদের দেশে ৮ রাকাত, ১২ রাকাত বিশিষ্ট যে নফল নামাজের কথা প্রচলিত আছে মূলত তার কোনো ভিত্তি নেই। আপনি যতো খুশি তত নফল নামাজ বা ক্কিয়ামুল লাইল আদায় করতে পারেন। আর এ নামাজ আদায় করতে হবে সূরা ক্কদর দিয়ে এ কথাও কিন্তু ঠিক নয়। আপনি যে সূরা পারেন সেই সূরা দিয়েই যতো খুশি তত নফল নামাজ আদায় করতে পারেন। এতে কোনো প্রকার বিধি নিষেধ নেই।
সর্বোপরি কথা হচ্ছে লাইলাতুল ক্কদর, আল্লাহর দেয়া বান্দার জন্য এক মহা অনুগ্রহ। যা পূর্ববর্তী কোনো নবীর উম্মতই পায়নি। তাই আসুন ক্কদরের রাতকে ক্কদর করি, রবের কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করি, দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা করি, তাহলেই আশা করা যায় আমরা মুক্তিকামিদের অন্তর্ভূক্ত হতে পারবো ইনশা আল্লাহ।
লেখক : সাংবাদিক ও ইসলামী গবেষক।
আলোকিত/06/04/2024/আকাশ