শেখ মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গানের চরণ দিয়ে শুরু হয়ে যাবে বরাবরের মতো আরেকটি বাংলা নতুন বছর ১৪৩১ বঙ্গাব্দ- ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। আদিকাল থেকেই মানবজাতির একটি ধারণা ছিল নতুন বছরের সাথে মানব জীবনের কল্যাণ জড়িত। যা আজও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি মনে করে। মানুষের স্বাভাবিক স্বভাবই হচ্ছে যাবতীয় দুঃখ থেকে দূরে থাকা। আর তাই সে বিভিন্ন উৎসব উদযাপনে সুখের কথা ভাবতেও পছন্দ করে। এমনই করে নতুন বছরকে বরণ করে উৎসবের নানাবিদ আয়োজনে। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা অনেক বেড়েছে। আরো বেশি করে অনেকটা উন্মাদনা লাভ করে ছোট বড় সবার মাঝে। বছর শুরুর প্রথম প্রহরে বর্তমান পৃথিবীর মানুষজন যে দুটি প্রধান বাৎসরিক গণনার সাথে বেশি পরিচিত। তার একটি হলো খ্রিস্টাব্দ যা খ্রিস্টানদের নবী হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের সময় থেকে গণনা শুরু হয়েছে। অপরটি মুসলমানদের নবী পৃথিবীর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)- এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সাথে সম্পৃক্ত। যা হিজরী সন হিসাবে গণনা শুরু হয়ে আজও চলমান রয়েছে। বাঙালি জাতি গোষ্ঠীর জন্য রয়েছে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ। যার শুরু হয় মোঘল শাসক সম্রাট আকবরের রাজ দরবার থেকে অর্থাৎ মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তক। যা ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে ১০-১১ মার্চ কার্যকর করা হয়। এই সন পূর্বে ফসলী সন হিসাবে পরিচিত ছিল। কেননা ওই সময় মানুষের একমাত্র পেশা ছিল কৃষি জমিনে ফসল ফলানো; আর এই ফসল দিয়েই মানুষজন রাষ্ট্রের কর পরিশোধ করতো। আর এই ফসলী সনই পরবর্তীতে বঙ্গাব্দ হয়ে আজও চালু আছে। বাংলা বছর শুরু হতো চৈত্র মাসের শেষ দিন রাষ্ট্রের খাজনা পরিশোধের মাধ্যমে। বৈশাখের নতুন ফসল দ্বারা বিভিন্ন উৎসবের মাধ্যমে যা আজও বাংলা ভাষাভাষী মানুষজন আয়োজন করে থাকে এবং বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে থাকে। সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত সনের অপর নাম ছিল তারিখে ইলাহী। আর বছরের বারো মাসের নাম ছিল যথাক্রমে- কারবাদিন, আর্দি, বিসুয়া, কোর্দাদ, তীর, আমার্দাদ, শাহরিয়ার, আবান, আজুর, বাহাম, ইস্কান্দার ও মিজ। কালক্রমে আকবর কর্তৃক মাসগুলোর নাম পরিবর্তন হয়ে বর্তমান বাংলা মাসগুলো নাম প্রচলিত হয়ে আসছে। ধারণা করা হয় ১২টি নক্ষত্রের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বর্তমান বাংলা ১২ মাসের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- বিশাখা থেকে বৈশাখ, জায়ীতা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবনী থেকে শ্রাবণ, কার্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ন, পউস্যা থেকে পৌষ, মাঘা থেকে মাঘ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন ও চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলা নববর্ষের উৎসবটি শুরু হয় ১৯১৭ সাল থেকে। যে উৎসবে সকল ধর্ম বর্ণ জাতি গোষ্ঠীকে আবদ্ধ করে। কী গ্রাম বা শহর সবাই এ উৎসবের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। ২০১৬ সালে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ী মহল নতুন করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো শুরু করে এবং পূর্বের সকল বাকি পাওনা উত্তোলনের জন্য গ্রাহকদেরকে দাওয়াতের আয়োজন করে। আদিকাল থেকেই শহর ও গ্রামে বর্ষবরণ উৎসবকে কেন্দ্র করে কিছু রীতি চালু আছে। যেমন- খুব ভোরে উঠে গোসল করে নতুন জামা কাপড় পড়ে একে অন্যের বাড়ি যাওয়া। ভালো রান্না করা পান্তা ইলিশের আয়োজন করা। মঙ্গল শোভাযাত্রা করা যা বর্তমানে শহর থেকে শুরু করে মফস্বল সর্বত্রই শুরু হয়েছে। যেখানে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষ সমানভাবে অংশগ্রহণ করে। আবার অনেক অঞ্চলে নববর্ষে আয়োজন করা হয় নৌকা বাইচের। এছাড়া আছে নাগরদোলা, জারি-সারি, বেহুলা লক্ষিন্দর পালা, ভাটিয়ালি সহ আধুনিক গানের আসর। ষাড়ের লড়াই, চট্টগ্রামের জব্বারের বলি উৎসব। সোনামণিদের জন্য থাকে মেলায় বিভিন্ন খেলনার উপস্থিতি। মাঠঘাট বাজার রাস্তার অলিগলিতে বসে বাহারি খাবারের দোকান। অঞ্চল ভিত্তিক প্রচলিত গ্রাম বাংলার শত বছরের সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান নববর্ষের উৎসব। এ উৎসব উদযাপনে পিছিয়ে নেই আমাদের পাহাড়ি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীও। তারাও সেখানে উদযাপন করে নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে তিনদিনব্যাপী বৈশাবী উৎসবের। তাইতো বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশ বলেন- ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাহি না আর ‘। বাঙালি জাতির ঐতিহ্য বাংলা নববর্ষ সার্বজনীন পালন করার জন্য এদিন সমগ্র দেশে সরকারি বেসরকারি কারখানা ও সকল দপ্তরের সাধারণ ছুটি থাকে। বর্তমান সংস্কৃতিপ্রিয় সরকার চালু করেছেন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য বৈশাখী উৎসব ভাতা। সর্বশেষ আমরা একথা বলতে পারি বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাঙালি জাতির কৃষ্টি কালচারের ও সংস্কৃতির মধ্যে অন্যতম। যেখানে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষ সবকিছু ভুলে এক প্লাটফর্মে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। এখানে উল্লেখ্য যে বর্ষবরণের নামে কোন ধরনের নারী পুরুষের প্রকাশ্যে অশ্লীলতাকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। যা অন্যের জন্য বিব্রতকর। এ ব্যাপারে অবশ্যই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সমাজে অপ্রচলিত অশ্লীল কাজকর্ম কোনো বোধ সম্পন্ন জাতি-গোষ্ঠী সমর্থন করতে পারে না।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
আলোকিত/১৪/০৪/২০২৪/আকাশ