ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অর্ধশতাধিক ব্যক্তি, মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে রাতারাতি বনে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা

0
872

এম জসিম উদ্দিন, (চট্টগ্রাম)

চাতরী গ্রামের শামসুল আলম, তার বাবার নাম আমির হামজা। আমির হামজা ছিলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আনোয়ারা থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান উকিল ফজলুল করিম এর দেহরক্ষী, তিনি ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ রাজাকারও। জনযুদ্ধ চলাকালে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মুক্তিবাহিনী থেকে প্রাণে বাঁচতে গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়ে চট্টগ্রাম শহরের আছাদগঞ্জ এলাকায় উকিল ফজলুল করিমের বাসভবনে আশ্রয় নেয় আমির হামজা। এ সংবাদ পেয়ে আনোয়ারার মুক্তিবাহিনীর একদল সদস্য উকিল ফজলুল করিমের বাসভবনে অভিযান চালিয়ে রাজাকার আমির হামজাকে গ্রেফতার করে। দেশদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রাজাকার আমির হামজাকে গুলি করে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তার লাশ আছাদগঞ্জ খালে ফেলে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমির হামজার প্রধান সহযোগী ছিলেন, তারই আপন পুত্র শামসুল আলম। মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শামসুল আলম গতবছর (২০২৩ ইংরেজি) মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। তার গেজেট নম্বর ৭৪৫৫, মুক্তিযোদ্ধা নম্বর ০১১৫০০১০০৫১।

আবেদন করার সময় তিনি যুদ্ধক্ষেত্র উল্লেখ করেছেন, কক্সবাজারের তার নানার বাড়ি। শামসুল আলম এখন সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নিয়মিত সম্মানি ভাতা পাচ্ছেন। রাজাকার আমির হামজার দ্বিতীয় পুত্রের নাম ইয়াকুব আলী। ইয়াকুব আলী দীর্ঘ ৭/৮ বছর ধরে আনোয়ারা পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় ব্যাংক (বিআরডিবির) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। বারখাইন গ্রামের আরেক বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। তার বাবার নাম মৃত মীর আহমদ। মুক্তিযুদ্ধের ঘোর বিরোধী এই ব্যক্তি মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে গতবছর (২০২৩ ইংরেজি) চুক্তিতে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে। হাবিবুর রহমান হচ্ছেন, সাবেক ভূমিমন্ত্রী আলহাজ্ব সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি’র এপিএস রিদুয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েম এর আপন ফুফা (ফুফুর স্বামী)। হাবিবুর রহমান আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির উপদেষ্টা সদস্য।

এর আগের কমিটিতেও তিনি উপদেষ্টা সদস্য ছিলেন। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইসহাক, বীর মুক্তিযোদ্ধা বাদশা মিয়া, ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নওশা মিয়া বলেন, রিদুয়ানুল করিম সায়েমের সহযোগিতায় হাবিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। এই চার বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, হাবিব মুক্তিযুদ্ধ করেননি, আওয়ামী লীগের রাজনীতিও কখনো করেননি। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মারা যাওয়ার পর সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপির বাসভবনে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে হাবিব রাতারাতি আওয়ামী লীগ নেতা বনে গেছে। হাবিবুর রহমানও নিয়মিত সন্মানি ভাতা পাচ্ছেন। হাবিবুর রহমানের গেজেট নম্বর ৭৫৮৪, মুক্তিযোদ্ধা নম্বর ০১১৫০০১০১৪৭। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে বারখাইন গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আবদুল গণি চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ধারে কাছেও যায়নি, এসকল অমুক্তিযোদ্ধারা চুক্তিতে মুক্তিযোদ্ধা বনে যাচ্ছে। এসব আমাদের জন্য লজ্জার। তিনি বলেন, এসব শুনলে আমারা ব্যতিত হই, মর্মাহত হই। অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছি, গতবছর (২০২৩ ইংরেজি) থেকে চলতি বছরে আনোয়ারায় ৫০ জনেরও অধিক ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। এর সিংহভাগই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।

তবে ২৩-২৪ সালের তালিকায় কয়েকজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্ধানও পাওয়া গেছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বিলপুর গ্রামের ৭১ এর শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আনোয়ারী, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল আনোয়ারী, বৈরাগ গ্রামের এম এ হক, ওষখাইন গ্রামের নারী মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারা বেগম প্রমুখ। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের ধারেকাছেও যায়নি এধরনের অহরহ অমুক্তিযোদ্ধা মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে। আবার অনেকে সন্মানি ভাতাও পাচ্ছেন। যেমন- পরৈকোড়া ইউনিয়নের ফজলুল হক, বখতেয়ার হোসেন চৌধুরী, বারখাইন গ্রামের সাজেদা বেগম, রনধির দাশ, মো. জাকের (গ্রাম- মাহাতা), আবু তাহের (গ্রাম-মোহাম্মদপুর), আহমদ নবী, আব্দুল নবী, দিলীপ কুমার মজুমদার সহ অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তারা নিয়মিত সন্মানিত ভাতাও পাচ্ছেন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে আনোয়ারা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার আবদুল মান্নান ও ডেপুটি কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম খান এর কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, গতবছর ২০২৩ ইংরেজি থেকে চলতি বছরের ২০২৪ এর এই পর্যন্ত ৫০ জনের অধিক মানুষ মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তারা সবাই ভুয়া নয়, আবার সবাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও নয়। তবে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকি সব ভুয়া। তারা একেকজন বিভিন্ন তদ্বিরে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এই দুই নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও কাগজেপত্রে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা। সরকার তাদেরকে সন্মানিত ভাতা দিচ্ছে, আমাদের করার কিছু নেই।

এ ব্যাপারে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের (জামুকার) ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ড. মুহাম্মদ নুরুল আমিন (উপসচিব) এর কাছে জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে সংযোগ কেটে দেন। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো মন্তব্য পায়নি। এ বিষয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের (জামুকার) পরিচালক (উন্নয়ন, পরিকল্পনা, এস্টেট ও কল্যাণ) মুহাম্মদ রুবাইয়াত শামীম চৌধুরী (উপসচিব) বলেন, জামুকা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্তা নিচ্ছে । তিনি বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এলাকার কেউ লিখিত অভিযোগ করলে জামুকা কতৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।

আলোকিত প্রতিদিন/এপি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here