আবু জুবায়ের :
২০২৪ সালের জুলাই মাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাধারণ ছাত্র জনতার উপর হাসিনা সরকার কর্তৃক পরিচালিত ভয়াবহ গণহত্যা, শেখ হাসিনার পতন ও নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অভিষেক দেশের ভবিষ্যৎকে নতুন করে নির্ধারণের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। জুলাই গণহত্যার পটভূমি, শেখ হাসিনার পতনের কারণ ও প্রভাব এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের প্রত্যাশার বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করব। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে দমাতে স্বৈরাচার হাসিনা এক ভয়াবহ গণহত্যা সঙ্ঘটিত করে । কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে বৈষম্য নিরসনের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন প্রাথমিকভাবে ছিল শান্তিপূর্ণ ও অরাজনৈতিক। শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে বৈষম্য বিরোধী , সুষ্ঠু নিয়োগ পদ্ধতির দাবি জানিয়ে রাস্তায় নেমে আসে, যা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু, সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনের প্রতি প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কঠোর। আন্দোলনকারীদের দমনের জন্য প্রথমে পুলিশি হামলা চালানো হয়, এরপর সহিংসতা আরও তীব্র হতে থাকে। র্যাব, বিজিবি, এবং সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে আক্রমণ করে , নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর সহিংসতা চালায়। সংবাদ মাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং আহতের সংখ্যা হাজারে পৌঁছেছে। এই সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ব্যাপক উত্তেজনা ও অসন্তোষের জন্ম হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বেড়ে যায়। ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে । এই পদত্যাগ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে শুরু করে। শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা এবং নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা। শেখ হাসিনার শাসনামলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্র এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি ও বিরোধী দলগুলোর ওপর নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর নিষেধাজ্ঞা এবং বিরোধী মতামতের ওপর অত্যাচার , নিষ্পেষণ সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। স্বৈরাচার হাসিনা সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে এবং গণতন্ত্রকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনও একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল শেখ হাসিনার আমলে । সরকারের পক্ষ থেকে মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান ও নাসিমা আক্তারের মতো ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা মানবাধিকার কর্মীদের কাজ করার পরিবেশকে সংকুচিত করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিচারকদের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ এবং বিচারের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছিল । গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলির ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষপাতিত্ব আইনগত এবং মানবাধিকারগত সমস্যা তৈরি করেছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার ছাড়াও, ডিজিটাল স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি অংশ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়, যা তথ্যের স্বাধীনতা সীমিত করে এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মতামত প্রকাশের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এই আইনটি সরকার বিরোধী মতামত এবং সমালোচনা দমন করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছিলো। অপহরণ এবং গুমের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিলো , যা সরকারের বিরোধী আন্দোলন ও সমালোচনার বিরুদ্ধে একটি ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের কারণে বহু ব্যক্তির গুমের ঘটনা ঘটেছে, যা মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির রক ভয়াবহ চিত্র ফুঁটে ওঠে। গুমের ঘটনায় সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক এবং সরকারের প্রতি অবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছিল। শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, তার মধ্যে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার রক্ষা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, দেশ পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং বিরোধী মতামতের মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে । মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের বিচার করতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য সরকারের স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আমাদের প্রত্যাশা, শেখ হাসিনার পতন এবং জুলাই গণহত্যার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন পরিবর্তনের দিকে যাবে । জনগণ ও গনতন্ত্রপন্থী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আমরা একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক, ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হব। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের নতুন করে শপথ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে—গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার , জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের সচেতনতা, ঐক্য, ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের ওপর।ফ্যাসিবাদীদেরকে মোকাবেলা করে একটি স্বাধীন , সার্বভৌম এবং সবার জন্য দেশ গঠনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখার এখনি সময়।
লেখক : কবি, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক (প্যারিস, ফ্রান্স)।
আলোকিত/২৩/০৮/২০২৪/আকাশ