ভালো নেই মানিকগঞ্জের সংবাদপত্র হকাররা, জীবনমান উন্নয়নে কল্যাণ ট্রাস্টটের দাবি 

0
171
ভালো নেই মানিকগঞ্জের সংবাদপত্র হকাররা, জীবনমান উন্নয়নে কল্যাণ ট্রাস্টটের দাবি 
ভালো নেই মানিকগঞ্জের সংবাদপত্র হকাররা, জীবনমান উন্নয়নে কল্যাণ ট্রাস্টটের দাবি 
মো. মিজানুর রহমান খান কুদরত : 
মানিকগঞ্জে ‘পেপারওয়ালার’ খবর রাখেনা কেউ। ভালো নেই জেলাসহ উপজেলার সংবাদপত্র হকাররা। সংবাদ পত্রে আসে না হকারদের কষ্টের জীবনের কথা। জীবনমান উন্নয়নে হকারদের কল্যাণ ট্রাস্টটের দাবি।
‘গরম খবর, গড়ম খবর’ ‘আজকের গরম খবর’, সব খবর জানতে পত্রিকা পড়ুন’- এমনি ভাবে ডাকতে থাকে পত্রিকার হকার। সেই কাক-পাখি ডাকা ভোরে শহর থেকে অলিগলি রাস্তায়, বাসা বাড়ির সামনে কিংবা গ্রামের মেঠোপথে হকাররা জীবনের চাকা ঘুরাতে পত্রিকা বিক্রি করেন। পাঠক তার পছন্দের পত্রিকাটি অন্তত পাঁচ থেকে দশ টাকার বিনিময়ে সারা পৃথিবীর খরব পেয়ে যায় নিমিষেই হাতের নাগালে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে খবরের কাগজের মালিক পক্ষ রাত ১২টার পর তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন পাঠক মহলে খবরের কাগজ পৌঁছবে বলে। কিন্তু একবারও কি পাঠক ভাবেন কার মাধ্যমে তার পছন্দের খবরের কাগজটি তিনি সহজেই পেয়ে যান? মালিক পক্ষ কি একবারও ভাবেন তার কোটি টাকার খবরের কাগজটা কে এসে তার পরিশ্রমের মাধ্যমে পাঠক মহলে ছড়িয়ে দেন? তিনি আর কেহ নন। তাকে পাঠক মহল এক নামে চেনেন তার নাম হলো, ‘হকার’ যাকে পত্রিকার হকার বলে চেনেন এমনকি তাকে অনেক সময় ডাকা হয়, ‘এই পেপার’, ‘ওই পত্রিকা’  ইত্যাদি নামে ডাকে। একটা পত্রিকার দাম যদি পাঁচ টাকা হয় তবে হকার পাঁচ টাকা বিক্রি করে পত্রিকার এজেন্ট এবং এজেন্ট পত্রিকার মালিককে দিয়ে কত টাকা হকার পায়? সে ক্ষেত্রে একজন হকার অবশ্যই নিরীহ মানুষ যার অঢেল টাকা কামানোর পথ নাই বলেই পত্রিকা বিক্রি করার জন্য নেমে যায়। সময়টা কখন পাঠক জানে? কি দিন কি রাত কি বৃষ্টি কি রৌদ্র, কি গরম কি শীত আকাশ পরিবেশের আবহাওয়া যেমনই থাক হকার তার আরামের ঘুম হারাম করে মোরগ ডাকার আগেই নেমে পড়েন সমিতি কিংবা এজেন্টের কাছ থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করার জন্য তার পরও ছুটে চলেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। সেই গভীর রাত থেকে নেমে সারা দিনের পরিশ্রমের ফল আসে একজন হকারের জন্য সর্বসাকুল্যে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। যেদিন ভালো চলে সেদিন ৪০০টাকা হয়। কিন্তু এই আয়ের কোনো নিরাপত্তা নেই। এমনকি সামান্য এই আয়ের নিমিত্তে বিপন্ন হয় পুরো জীবনটাই। তাছাড়া পরিবার-পরিজন ও সন্তান লালন-পালন করে তাদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ এই আয় দিয়ে টিকে থাকা মুশকিল। এরই জনবহুল ব্যস্ত এই এলাকায় খবরের কাগজ বিক্রির উলেখযোগ্য বাজার হিসেবে বেছে নেন রাস্তার চলমান গাড়িগুলোকে। সে জন্য দিতে হয় দৌড়ঝাপ। সে ক্ষেত্রে দূর্ঘটনায় পড়া স্বাভাবিক। পাঠকের কাছে নিজের জীবন বাজি রেখে খবরের কাগজ পৌঁছায় ঠিকই কিন্তু দূর্ঘটনায় তাদের পাশে কেউ থাকার নাই। প্রাকৃতিক রোগব্যাধি তো থাকেই। এই এলাকার হিসাব অনুযায়ী একজন হকারের মাসিক আয় সর্বসাকুল্যে ৯ হাজার টাকা। ব্যস্ততম এই শহরের পারিপার্শ্বের সাপেক্ষে ৯ হাজার টাকায় টিকে থাকার কথা না থাকলেও নিজের সমস্যা ঢেকে পাঠকদের পত্রিকা ঠিকই পৌঁছে দেয় হকার। তাদের সম্বন্ধে ভাবার জন্য নাই পাঠকের সময় না পত্রিকার হকার সমিতির সময় না পত্রিকার মালিক পক্ষের সময়। সংবাদপত্র বিক্রি করে হকাররা লাভ পান কমিশন অনুযায়ী। প্রকাশকের কাছ থেকে হকার্স সমিতি পত্রিকা প্রায় ৪০ শতাংশ কমিশনে। এর মধ্য থেকে হকাররা পত্রিকা পান ৩৫ শতাংশ কমিশনে। মাঠ পর্যায়ের হকাররা অনেক পত্রিকার ক্ষেত্রেই নির্ধারিত কমিশন পান না। মধ্যস্বত্ব ভোগীরা তাতে ভাগ বসায়। ১৯৭৪ সাল থেকে এই একই রেটে চলছে পত্রিকা বিপণন। অনেক সময় গড়িয়েছে। তিন টাকার পত্রিকা ১২ টাকা হয়েছে, সবার লাভ বেড়েছে। কিন্তু হকারদের আয় বাড়েনি। অনেকে পত্রিকার সংখ্যার কথা বলেন, কিন্তু হকাররা বলছেন, তাতে কাজ হচ্ছে না। সার্বিকভাবে তারা পিছিয়ে পড়ছেন।
মাস্টার্স পাস করে চাকরী না পেয়ে পত্রিকার হকার পেশায় থাকা মো. বুলবুল ইসলাম বলেন, অনেক পত্রিকা আছে তারা বেচে যাওয়া পত্রিকা ফেরত নেয় না। আমাদের আয় কম। পাঁচটা পত্রিকা বেচলে ১৫ টাকা লাভ হয়। একটা থেকে গেলে তার পুরোটাই ক্ষতি। বড় পত্রিকাগুলো ফেরত দিতে ঝামেলা হয়। দু’চারটা ফেরত নেয়, বাকিগুলোর নিজের পকেট থেকে গচ্চা দেয়া লাগে। বৃষ্টির মৌসুম এলে নিয়মিত পত্রিকা ভিজে যায় আবার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক সময় পত্রিকা বিক্রি করতে রাস্তায় নামাই যায় না। শত ঝামেলা পেরিয়েও হকাররা নিয়মিত পাঠকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও ঠিক সময়ে পত্রিকা পৌঁছে দেন। মাস শেষে যখন নিজেদের হিসেবের খাতা খুলেন প্রহসন আর মানসিক কষ্ট ছাড়া আর কিছু না। এভাবেই চলছে মানিকগঞ্জের হকারদের কষ্টের জীবন।
পত্রিকার হকার মোহন দাস বলেন, গ্রামে পত্রিকা এখন খুব কম বিক্রি হয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকলেই খবর পড়ে থাকে। আগের চেয়ে এখন পত্রিকা তেমন চলে না। তবুও পত্রিকা বিক্রি করছি অল্প স্বল্প নিজেদের খরচ বাড়লেও পত্রিকার দামও আমাদের পাওনা তো বাড়ে না। বছরে দুটো ঈদ আসলে পত্রিকার হকাররা পান না কোনো অতিরিক্ত মূল্য-বোনাস। স্বাধীনতার পর থেকে দিনের পর দিন যে কোনো পত্রিকার দাম বেড়েছে। কিন্তু বাড়ে নি হকারদের শ্রমের মূল্যের। অষ্টম ওয়েজ বোর্ড হিসেবে সাংবাদিকরা বেতন পায় ঠিকই কিন্তু প্রেসের আওতায় আসে না সাংবাদিকদের সংবাদ বাহকের বাইরের মূল সংবাদ বাহক তথা হকাররা। সাংবাদিক, সম্পাদক প্রকাশকরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের নিচে বসে সংবাদ লিখেন, ছাপান কিন্তু এই সংবাদ ও সংবাদপত্র যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এলাকার পাড়া-মহল্লা এমনকি শোবার ঘরে নিয়ে পৌঁছায় তাদের দুর্দশা জীবন ও কষ্টময় জীবিকার কথা বৈচিত্রময় সংবাদপত্রে আসে না। রাতের প্রহর কাটিয়ে ভোর হলেই চোখ মেলে পত্রিকার শিরোনামগুলোতে চোখ বুলালে আতংকিত আমরা হই ঠিকই কিন্তু যারা সর্বদায় পাঠকদের জন্য নিজেরাই আতংকে থাকেন তাদের খবর আমরা নিজেরাও নেই না এমনকি সংবাদপত্রে কখনও আসতে দেখি না। সাংবাদিকদের  জাতীয় প্রেসক্লাবে হয়েছে কি হকারদের নিয়ে কোনো সম্মেলন? কিন্তু পত্রিকার সাংবাদিক-সম্পাদক ও প্রকাশক, পাঠক আমার আপনার সকলেরই উচিত পত্রিকার হকারদের ন্যায্য অধিকার পাওয়ার ব্যবস্থা নেয়া। যাদের অঢেল ও সীমাহীন পরিশ্রমের ফলে আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্র পাই এবং পড়ি তাদের জন্য সাংবাদিক, সম্পাদক, পাঠক এমনকি উভয়ের কিছু একটা করা দরকার। এ ক্ষেত্রে জাতীয় প্রেসক্লাব ও তথ্য মন্ত্রণালয় রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন দেশের লেখক সাহিত্যিকরা। যাদের কলমের খোঁচায় ওঠে আসবে হকারদের দূর্ভোগের কথা। হকাররা হয়তো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসায় থাকার স্বপ্ন দেখে না তবে একটু ভালো করে বাঁচবে। তিন বেলায় ডাল-ভাত খাবে এমন আশা করতেই পারে।
মানিকগঞ্জ শহর এলাকার সংবাদপত্র হকার শ্রী নগেন সরকার বলেন, ৫০ বছর ধরে এই হকারি পেশায় আছি। সংবাদ পত্রে আসে না হকারদের কষ্টের জীবনের কথা। ‘সরকার, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সবাই কম বেশি সহযোগিতা পাচ্ছে। কিন্তু আমরা সাংবাদপত্রের হকারদের কথা যেন কারো মাথায় নেই। অথচ প্রতিটি নাগরিক জীবনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আমরা। আমরাই মানুষের দ্বারে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে দিচ্ছি। কিন্তু আজ আমরা যে কষ্টে আছি এদিকে কারোই খেয়াল নেই।
সংবাদপত্র বিক্রেতা সবুজ মিয়া বলেন, কাজ নেই, কিন্তু পেটতো আর বুঝে না। সংসারে ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা ও স্ত্রী রয়েছে। তাদেরতো খাওয়াতে হয়। তার উপরে বাড়ি ভাড়া আছে। এছাড়া দেশের এমন পরিস্থিতিতে চার দিকে নানারকম রোগব্যাধি লেগে রয়েছে। সবার জন্যই ওষুধপত্রও লাগে, আবার সমনে রমজান মাস। সবরকম দ্রব্যমূল্যের দামও আকাশ চুম্বী। কিভাবে যে আমরা চলছি এক মাত্র আল্লাই ভালো জানে। আমাদের জন্যও ভাবা উচিৎ সরকারের। তাহলে আমরাও পরিবার নিয়ে খেয়ে বাঁচতে পারবো। তাই আমরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। সবার মত আমাদেরও একটি তালিকা করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হোক।
ঘিওর উপজেলার সার ডিলার- সংবাদপত্র পাঠক মো. আব্দুল খালেক বলেন, তেমন ভালো নেই সংবাদপত্র হকাররা। সূর্যের আলো ফোটার আগেই মানুষের বাসা-বাড়ি, সরকারি- বেসরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে যায় খবরের কাগজ। রোদ, ঝড়-বৃষ্টি সবরকম পরিবেশেই নিরলস পরিশ্রম করে হকাররা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয় খবরের কাগজ।
মানিকগঞ্জের বহুল প্রচারিত স্থানীয় আল-আযান পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক এড. আমিনুল হক আকবর বলেন, হকারদের জীবনমান উন্নয়নে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। হকারদের কল্যাণে সরকারি ভাবে নিবন্ধনের মাধ্যমে কল্যাণ ট্রাস্টটের আওতায় আনা হলেই তারা সুদিনের আলো দেখতে পারবে। পাশাপাশি তাদের পত্রিকার হকার সমিতির মাধ্যমে দুরর্দিন  পরিবর্তন করতে হবে।
জেলা ও উপজেলার অবহেলিত পত্রিকার হকাররা তাদের জীবন মান উন্নয়নে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।
আলোকিত প্রতিদিন/০৩ ডিসেম্বর-২৪/মওম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here