এম. জসিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম: যে ব্যক্তি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, ওষখাইন গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা: আবু তাহের ও নিজ গ্রাম হাইলধরের আপন চাচাতো ভাই স্বাধীনতা সংগ্রামী জাকারিয়া চৌধুরী জকু হত্যার মদদ দিয়েছিলেন, যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্বর্ণ কেলেঙ্কারি, চোরাকারবারি, খুন-খারাবিসহ নিকৃষ্টতর অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে, সেই ব্যক্তিকে কীভাবে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ খেতাব স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত করা হয় বা এখনো কীভাবে এই খেতাব বহাল থাকে! স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্ণ হলো। এই শুভক্ষণে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দাবি! দাবিটি হচ্ছে, যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া কাপুরুষ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক বাতিল, পদক ফেরত নেয়া হোক।
বিগত ২০২২ সালে মাগুরার শ্রীপুরের আমির হামজার স্বাধীনতা পদক বাতিল এবং ২০২০ সালে এস.এম. রইজ উদ্দিনের স্বাধীনতা পদক যেভাবে ১২ মার্চ বাতিল করা হয়েছিল। চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্ন- শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম-এর চেয়েও কি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সম্মানিত বা দেশ ও জাতির জন্য অবদান রেখেছেন ? কে এই আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু? কোথায় ছিল তার খুঁটির জোর? তার পদক আজও কেন বহাল আছে; কেন বাতিল করা হচ্ছে না ? কারণ, এই স্বাধীনতা পদক আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ এবং জাতির জন্য চরম অবমাননাকর! যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার অপরাধে ও স্বর্ণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাবুকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করেছিলেন।
বাবু বহিষ্কার হওয়ায় ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর আপন চাচাতো ভাই এম. ইদ্রিস বিকম। ওই নির্বাচনে এম. ইদ্রিস বিকম বিপুল ভোটে জয়ী হন। ১৯৯১ সালে শিল্পপতি হুমায়ুন জহিরকে হত্যার পর বাবু দেশত্যাগ করলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পান এম. ইদ্রিস বিকম। এছাড়াও আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পিতা নুরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন আনোয়ারা থানা শান্তি কমিটির সদস্য, তিনি ছিলেন রাজাকারদের আশ্রয়দাতা। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নুরুজ্জামানের ঘরটি ছিল রাজাকারদের আশ্রয়স্থল। পটিয়া থানা রাজাকার কমান্ডার (আজিমপুর গ্রাম) কুখ্যাত সোহাগ মিয়াকে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা যখন গ্রেফতার করার জন্য সমগ্র পটিয়ায় সাড়াশি অভিযান চালাচ্ছিলেন, তখন রাজাকার সোহাগ মিয়া গ্রেফতার এড়াতে ও প্রাণ রক্ষার্থে পার্শ্ববর্তী থানা আনোয়ারার হাইলধর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার নুরুজ্জামান চৌধুরীর ঘরে আশ্রয় নেয়।
এ সংবাদ পেয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে চন্দনাইশের দুই গ্রুপ কমান্ডার হাবিবুর রহমান চৌধুরী ও শাহাজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা হাইলধর গ্রামের নুরুজ্জামান চৌধুরীর বাড়িটি ঘিরে ফেলে। নুরুজ্জামানের ঘরে লুকিয়ে থাকা রাজাকার কমান্ডার সোহাগ মিয়াকে মুক্তিবাহিনীরা আটক করে পীরখাইন-বরকল মধ্যবর্তী চানখালী খালপাড়ে গুলি করে খালে ভাসিয়ে দেয়। পরে মুক্তিবাহিনীর দলটি পুনরায় রাজাকারদের আশ্রয়দাতা নুরুজ্জামান চৌধুরীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলে নুরুজ্জামান মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে কোনোরকম রক্ষা পায়।
তাছাড়া ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংকের প্রধান উদ্যোক্তা নোয়াখালীর শিল্পপতি হুমায়ুন জহির হত্যা, ইউসিবি ব্যাংকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী নিয়ে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সাতকানিয়ার জাফর আহমেদ চৌধুরীকে হেনস্তা করে ক্যাশের টাকা লুটপাট, নিজ বাড়ির আপন চাচাতো ভাই জকরিয়া চৌধুরীসহ স্বাধীনতাকামী অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে আনোয়ারা থানার মুক্তিবাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শামশুল আলম মাস্টার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়েছে- ঘটনাটি সত্য।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাবু লন্ডন আমেরিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নামে প্রবাসী বাঙালির কাছ থেকে গণহারে চাঁদাবাজি করেছে। পরৈকোড়া ইউনিয়নের বাথুয়া পাড়ার ৭১-এর শহীদ পরিবারের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরজিত দাশ শুনু বলেন, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ইন্ধনে তার আপন ভগ্নিপতি কুখ্যাত রাজাকার খায়ের আহমদ চৌধুরী ওরফে খরাতি মিয়ার সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী পুর্ব আনোয়ারায় ১৭৬ জন স্বাধীনতাকামী বাঙালি ও অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে।
তিনি আরও বলেন, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক বাতিল করতে হবে। এ ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব খান রফিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড শাহ আলমসহ আরও কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু যুদ্ধের শুরু থেকে মাত্র কিছুদিন দেশে ছিল। পরে প্রতিকুল পরিস্থিতিতে তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে অন্যত্র পালিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। তার মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক বাতিল এখন সময়ের দাবি। চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বাবুর কুকীর্তি-অপকর্ম লিখতে গিয়ে মৃত্যুর হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন অসংখ্যবার। এমনকি বাবুর স্বাধীনতা পদক পাওয়া নিয়ে বিস্মিত হয়েছেন চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার সকলেই। তখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কী এমন কৃতিত্বপূর্ণ অবদান মূল্যায়ন করে তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়েছিল? নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রামের কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বলেন, যারা বাবুকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল তাদের শাস্তি চাই। গবেষকদের বুকে চেপে বসে গলা টিপে ধরতো বাবু। বাবু মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের বলতেন, তিনি (বাবু) যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাননি। বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করতে ভারত, লন্ডন, আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন বাবু।
জাতির কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্ন; বিশ্ব নেতাদের সাথে কথা বলতে গেলে কতটুকু শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন? আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ফেল। মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, শেখ হাসিনার সরকার এসব কুলাঙ্গারদের পুরস্কৃত করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে চরমভাবে কলঙ্কিত করেছে। চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক নেতা বলেন, ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ১৯৭১-এ যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া কাপুরুষ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর স্বাধীনতা পদক বাতিল ও পদক ফেরত নিয়ে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করবেন। ৭১-এ যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া কাপুরুষ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু
আলোকিত প্রতিদিন/এপি