আলোকিত প্রতিবেদক: রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় মা-বাবা ও চার বোনের সঙ্গে থাকতেন বৃষ্টি (ছদ্মনাম)। টানাটানির সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় চাকরি খুঁজছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে ফেসবুকে নদী আক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। নদী তাঁকে পার্লারে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে ভারতে পাচার করেন তিনি।
বৃষ্টির এই ঘটনা শুধু একজন-দুজনের নয়। সংঘবদ্ধ পাচারচক্র এমন আরো অনেক তরুণীকে চাকরি দেওয়াসহ নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ভারতে পাচার করে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীকে ভারতে পাচারে করে বিনিময়ে সেখান থেকে গরু নিয়ে আসা হয়।
ভারতে মানবপাচারের ঘটনায় ২০২১ সালে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় করা পৃথক চারটি মামলার তদন্ত শেষে সম্প্রতি ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগ আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। এতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, সিটিটিসির পরিদর্শক মো. সেলিম আকতার ও উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আব্দুর রউফ তালুকদারের দেওয়া অভিযোগপত্রে আসামি রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় ও আসামি নদী আক্তার ওরফে ইতি ওরফে নূরজাহানসহ ৫১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
আরো ৪৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও তাঁদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি৷ এ জন্য তাঁদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করা হয়। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে আসামি রুবেল সরকার রাহুল ও আশরাফুল ইসলাম রাফি এখন কারাগারে। ২৮ আসামি পলাতক ও অপর আসামিরা জামিনে রয়েছেন।
ভারতে মানবপাচারে জড়িত অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন মো. ইসরাফিল হোসেন খোকন, মো. তরিকুল ইসলাম, মো. আল আমিন হোসেন, আব্দুল হাই ওরফে সবুজ, সাইফুল ইসলাম, বিনাস সিকদার, মো. আমিরুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম রাফিসহ অন্যরা।
নারী পাচার করে গরু আনা হয় :
মানবপাচার চক্রের সদস্য আল আমিন হোসেনের বাড়ি যশোরের শার্শায়। স্বল্প শিক্ষিত এই ব্যক্তি জমিজমা সব বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে পাচারে সক্রিয় হন। পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলে তিনি আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। ভারতে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত আছে।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘ভারতে আমি মেয়ে নিয়ে যেতাম এবং গরু নিয়ে ফিরতাম। আমার সঙ্গে মূলত শফিকুল, আক্তারুল, অলি, জয়ন্ত, শহীদ কাজ করে এবং তারা সবাই আমার গ্রামের। নদী চাকরি দেওয়ার কথা বলে ঢাকা থেকে মেয়েদের এনে ভারতে পাচার করতেন।’
আল আমিন বলেন, ‘ঢাকা বা বিভিন্ন স্থান থেকে মেয়েদের বর্ডারে নিয়ে এলে আমিরুল, আব্দুল হাই ও সিরাজুল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। তরিকুলের ইজি বাইকে করে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিত। মেয়েদের আমার বাড়িতে রাখতাম। বিনিময়ে জনপ্রতি ২০০ টাকা পেতাম। খোকন নিজে কিংবা সাইফুলের মাধ্যমে বিকাশ করত।
পুলিশ এলাকায় ঢুকলে নেছার উদ্দিন ও সাইফুল সতর্ক করে দিত। আমরা একটা মেয়ে ভারতে পাচার করতে পারলে জনপ্রতি এক হাজার টাকা পেতাম এবং নেছার উদ্দিনকে জনপ্রতি এক হাজার টাকা দিতে হতো। আমি প্রায় ৫০-৬০ জন মেয়েকে বর্ডার দিয়ে পার করেছি।’
৩০০-৫০০ টাকা পেতেন নৌকার চালক :
শার্শা থানার ভুলাটে মো. আমিরুল ইসলামের বাড়ি। তিনি নৌকা বা শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌযানে করে ভারতে পারাপারের কাজ করতেন৷ এ জন্য তিনি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পেতেন। গ্রেপ্তারের পর জবানবন্দিতে তিনি এসব তথ্য দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি কমবেশি ৭০ থেকে ৮০ জনকে ভারতে পার করেছি। নেছার মেম্বারের সহযোগিতায় মেয়েদের আমরা ভারতে পলক মণ্ডল, বকুলের কাছে পৌঁছে দিতাম। পারাপারে কোনো মেয়ে ধরা পড়লে নেছার মেম্বার ছাড়িয়ে আনতেন।’
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী কালের কণ্ঠকে বলেন, যারা দেশের বাইরে থাকে, তারা স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে মানবপাচার করে থাকে। এ ক্ষেত্রে মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। অনেকে জামিন পেয়ে ফের এ ধরনের কাজে জড়িয়ে পড়ে। তাই ভারতে পাচারের ঘটনায় করা মামলাগুলোর তাড়াতাড়ি বিচার করা উচিত।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সালমা আলী বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধ আইনের সঠিক প্রয়োগ ও নজরদারি নেই। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সংঘবদ্ধ চক্র নারীদের ভারতে পাচার করে। এদের সঙ্গে সরকারের লোকজনও জড়িত। অত্যন্ত দ্রুত সময়ে বিচার শেষ করে দোষীদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে।
ডিএমপির (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা মামলার মেরিট অনুযায়ী তদন্তকাজ করি৷ মানবপাচারে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, আইনগত দিক বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়।
আলোকিত প্রতিদিন/এপি