ভারতের টিভি সংবাদ যেন রেসলিংয়ের ‘স্যুট পরা সংস্করণ’:দ্য ইকোনমিস্ট 

0
55
ভারতের টিভি সংবাদ যেন রেসলিংয়ের ‘স্যুট পরা সংস্করণ’:দ্য ইকোনমিস্ট 
ভারতের টিভি সংবাদ যেন রেসলিংয়ের ‘স্যুট পরা সংস্করণ’:দ্য ইকোনমিস্ট 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রাতভর আকাশযুদ্ধের খবর যারা নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছেন, তারাও হয়তো কিছু ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ ঘটনার কথা জানেন না। যেমন—ভারতীয় নৌবাহিনী করাচি বন্দরে হামলা চালিয়েছে, ভারতের সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করেছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাঙ্কারে পালিয়েছেন কিংবা সেদেশের সেনাপ্রধানকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এসব যদি আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়, তার কারণ একটাই—এগুলোর কিছুই আসলে ঘটেনি। কিন্তু তা ভারতের সম্প্রচারমাধ্যমকে থামাতে পারেনি। যুদ্ধের পরিবেশে, পেছনে সাইরেনের শব্দ ও আকাশে কার্টুন ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত, এসবই তারা ‘খবর’ হিসেবে পরিবেশন করেছে। এমনকি এক উপস্থাপক দর্শকদের আশ্বস্ত করেছেন—‘সব তথ্য যাচাই করেই প্রচার করা হচ্ছে।’

সংবাদ যদি কল্পনাপ্রসূত হয়, তা হলে মন্তব্যগুলো ছিল আরও ভয়াবহ। একজন সঞ্চালক তো সরাসরিই বললেন: ‘করাচিতে আগুন লাগিয়ে দাও, পুরো শহরটা উড়িয়ে দাও।’ এক চ্যানেলে এক সাবেক সেনা কর্মকর্তা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে গালিগালাজ করায় কূটনৈতিক সংকটও তৈরি হয়।

ভারতীয় টেলিভিশন সংবাদ অনেক আগেই বাস্তবতার জগৎ থেকে সরে গেছে। প্রতি রাতেই সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীকে প্রশংসায় ভাসানো হয়, বিরোধীদের নিন্দা করা হয়, সংখ্যালঘু ও বিদেশিদের অবজ্ঞা করা হয়।

এই জাতীয়তাবাদী শোরগোল দর্শকদের একাংশের কাছে যেন ‘ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেইনমেন্ট’-এর স্যুট পরা সংস্করণ। এর পেছনে একটি কৌশলও আছে—টিভি সংবাদ এখন কেবল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) স্বার্থ রক্ষা করে, আর তার ‘শত্রুদের’ ধ্বংস করে।

বিশ্লেষক মনীষা পাণ্ডে ঠিকই বলেন, ‘আপনি যদি নিজেকে জাতীয়তাবাদী চ্যানেল দাবি করেন, তাহলে অন্তত জাতীয় স্বার্থে কাজ করুন।’ কিন্তু গত ৭ মে কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর ‘অযাচিত সন্ত্রাসী হামলার’ জবাবে ভারত পাকিস্তানে হামলা চালানোর পর থেকে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো বরং উল্টো কাজই করেছে।কূটনীতিক ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা যখন সরকারি ব্রিফিংয়ে ‘বিষয়টিকে বাড়াবাড়ি নয়’ বলে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, তখন টিভিতে একজন অতিথি প্রার্থনা করছিলেন, ‘আশা করি পাকিস্তান এমন ভুল করবে যাতে আমরা আসল মজা নিতে পারি।’

এমন মুহূর্তে মিডিয়ার কাজ হওয়া উচিত ছিল রাষ্ট্রের বার্তা জনতার ও বিশ্বের কাছে পৌঁছানো, কিন্তু ভারতীয় টিভিগুলো সেক্ষেত্রে একেবারেই ব্যর্থ হয়। তার ফলে, ভারত আক্রান্তের পরিবর্তে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত হয়।

মিথ্যাচারে কার ক্ষতি: 

দেশের ভেতরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো ক্ষতি করেছে নিজ দর্শকদেরও। ড্রোন হামলা, গণআত্মঘাতী বিস্ফোরণ ইত্যাদি নিয়ে নানা গুজব ছড়িয়েছে। সীমান্তবর্তী জনগণ, যারা প্রকৃত আক্রমণের মুখোমুখি হচ্ছিল, তারা সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত ছিল। দেশের অন্যান্য অংশ বোমা থেকে মুক্ত ছিল বটে, কিন্তু মিথ্যা তথ্য থেকে নয়। পত্রিকাগুলো তুলনামূলক নির্ভরযোগ্য হলেও সংঘর্ষগুলো রাতে ঘটায় সংবাদ দেরিতে পৌঁছেছে।

এই বিভ্রান্তি থেকে বিজেপিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ টেলিভিশন দেখে ভারতীয় জনগণ ভেবেছিল, তাদের দেশ পাকিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। সবাই ধরে নিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দৃঢ় নেতৃত্বে পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন হঠাৎ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন, তখন সবাই হতাশায় ভেঙে পড়ে।

এই হতাশা রূপ নেয় ক্ষোভে। এর অগ্রদূত হিসেবে ছিলেন টিভি সঞ্চালক অর্ণব গোস্বামী, যিনি রীতিমতো চিৎকার করে বলেন, ‘এই তো ট্রাম্পের চিরাচরিত হস্তক্ষেপ… আমরা ওদের গুঁড়িয়ে দিচ্ছিলাম… আমি এটি (যুদ্ধবিরতি) মানি না। আমরা শেষ করেই ছাড়বো।’ এরপর ক্ষুব্ধ জাতীয়তাবাদীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে গালিগালাজ করতে থাকেন।

গত ১২ মে প্রধানমন্ত্রী মোদী জাতির উদ্দেশে ভাষণে শক্তির প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কথিত পাকিস্তান-ভারত আলোচনার খবর অস্বীকার করেন। বিজেপি পরে দেশজুড়ে বিজয় র‌্যালির ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাস্তবে খুব কম ভারতীয়ই সরকারের এই ‘জয়ের’ প্রচারে বিশ্বাস করেন। এর জন্য বিজেপি এখন নিজের চাটুকার টিভি চ্যানেলগুলোকেই দায়ী করতে পারে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন

আলোকিত প্রতিদিন/১৭মে ২০২৫/মওম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here