সাম্য হত্যা নিয়ে ধোঁয়াশা, প্রধান আসামি গ্রেপ্তার না হলেও পুরস্কৃত পুলিশ!

0
39

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিলেও এই মামলার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ পর্যন্ত তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হলেও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, মূল হত্যাকারী এখনও পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে এখনও।

এছাড়া ঘটনার তদন্তে সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দাবি করছে পুলিশের দুই পক্ষ।

হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও যে ব্যক্তির ছুরিকাঘাতে সাম্য নিহত হন, তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি বলে দাবি করেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাম্যর সহপাঠীসহ অন্যান্য ঢাবি শিক্ষার্থীরা।

রহস্য উদঘাটন করেই পুরস্কৃত পুলিশ

এদিকে, দ্রুততম সময়ে সাম্য হত্যার রহস্য উদঘাটন ও আসামি গ্রেপ্তারের স্বীকৃতিস্বরূপ বৃহস্পতিবার শাহবাগ থানা পুলিশের সংশ্লিষ্ট টিমকে নগদ এক লাখ টাকা পুরস্কার দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তার পরের দিনই (শুক্রবার) সাম্য হত্যায় জড়িত মূল হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে শাহবাগ থানা অবরোধ করে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি-সাম্য হত্যার যিনি মূলহোতা, অর্থাৎ যিনি ছুরিকাঘাত করেছেন, সাদা শার্ট বা পাঞ্জাবি পরা সেই ব্যক্তি ও তার সব সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে হবে।

তবে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে হত্যাকারীকে ধরতে পারেনি পুলিশ- অভিযোগ তুলে রবিবার আবারও শাহবাগ থানা ঘেরাও করেন শিক্ষার্থীরা।

ঘটনার বর্ণনা ও হত্যাকাণ্ড-

প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৩ মে দিবাগত রাতে সাম্যর সঙ্গেই ছিলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আশরাফুল আলম রাফি ও আব্দুল্লাহ আল বায়েজিদ। ওই সময় খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে মোটরসাইকেলে চড়ে রমনা কালী মন্দির গেট দিয়ে উদ্যানে প্রবেশ করেন তারা। পরে খাওয়া শেষে একটি শিশুর হাতে থাকা “টিজার গান” কাড়তে গিয়ে অন্য একটি পক্ষের মোটরসাইকেল ধাক্কা লাগে তাদের। আর এ নিয়েই শুরু হয় কথা কাটাকাটি, যা একপর্যায়ে প্রাণঘাতী মারামারিতে রূপ নেয় তখন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী বায়েজিদ বলেন, “সেদিন আমাদের ইনস্টিটিউটের একটি প্রোগ্রাম ছিল। প্রোগ্রাম শেষ করে রাতে খাওয়া-দাওয়া করতে উদ্যানের গেটের দোকানগুলোতে যাই। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে খাওয়া শেষে সেখান থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম। তার মধ্যেই এই বিপত্তি।”

তিনি বলেন, “মুক্ত মঞ্চের পাশে (হত্যাকাণ্ডের স্থানের পাশে) দুটি অল্পবয়সী শিশু ছিল। মন্দিরের গেট দিয়ে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের একজন আমাদের লক্ষ্য করে টিজার গান সদৃশ কিছু একটা মারে। শিশুদের হাতে এগুলো থাকা নিরাপদ না ভেবে সাম্য গাড়ি ঘোরায়। এ সময় আমরা বাচ্চাটিকে ধরতে গেলে সে পালনোর চেষ্টা করে। এ সময় সেখানে কয়েকজন বসে ছিলেন। তাদের দিকে আমাদের খেয়াল ছিল না। হঠাৎ তাদের একটি বাইকের সঙ্গে আমাদের (বাইকের) ধাক্কা লাগে। এরপরই ওই ব্যক্তিরা আমাদের ওপর তেড়ে আসে।”

ওই ঘটনায় আহত এই শিক্ষার্থী বলেন, “শুরুতে কথা কাটাকাটি হয়, পরে তারা প্রভাব দেখাতে চাইলে আমরাও উত্তেজিত হয়ে যাই। একপর্যায়ে পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হওয়া লাল টি-শার্ট পরা ব্যক্তি আমাকে মাটিতে ফেলে মারধর শুরু করে। ১-২ মিনিটের মধ্যেই ঘটনার আকস্মিকতা সামলে দেখি, সাম্য উঠে দাঁড়িয়েছে। তারপর চোখ যায় তার পায়ের দিকে। দেখি, তার ডান পা রক্তাক্ত। তার পরপরই ধুপ করে পড়ে যায় সে।”

কথা বলতে গিয়ে এ সময় কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে বায়েজিদের। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন, “এরপর আমরা ওকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সাহায্য চাই, কিন্তু কেউ সে সময় এগিয়ে আসেনি। পরে একটি ছোট বাচ্চার সাহায্য নিয়ে ওকে (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালে নিয়ে যাই।”

মূলত তাদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর কথা কাটাকাটি ও ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সাদা শার্ট বা পাঞ্জাবি পরা এক যুবক বড় ছুরি জাতীয় কোনো অস্ত্র দিয়ে সাম্যর পায়ে আঘাত করেন। এর পরপরই তিনটি মোটরসাইকেলে করে তাদের ১০-১২ জনের একটি দল দ্রুত পালিয়ে যান বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, “অস্ত্রের আঘাতে সাম্যর ডান পায়ের উরুতে গভীর ক্ষত হয়। কাটা জায়গা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। হাসপাতালে নিতে নিতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েই মারা যায় সে।”

পরে এ বিষয়ে ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, “উরুর পেছনে শরীরের একটি অন্যতম প্রধান রক্তনালী থাকে, যাকে বলা হয় ফিমোরাল আর্টারি। এটিকে বলতে পারেন দেহের প্রধান রক্তনালীর একটি শাখা রক্তনালী, কিন্তু এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই রক্তনালী কেটে যাওয়ার পর হাসপাতালে আনতে দেরি হওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।”

আসামিদের গ্রেপ্তার নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া-

এই ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হলে নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরের দিন (বুধবার) সকালে রাজধানীর পৃথক তিনটি স্থান থেকে তিনজনকে আটক করে পুলিশ।

হত্যার ঘটনায় নিহতের ভাই শরিফুল আলম শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আটক তামিম হাওলাদার (৩০), সম্রাট মল্লিক (২৮) ও পলাশ সরদারকে (২৮) আদালতে তোলে পুলিশ। এরপর তাদের প্রত্যেককে ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

তবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন আসামিদের তিনজনই। তারা আদালতকে বলেন, “হয়রানি করার জন্য আমাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।”

অন্যদিকে, গ্রেপ্তারদের অপরাধের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী বায়েজিদের দাবি, তারা ঘটনাস্থলেই ছিলেন। তিনি বলেন, “গ্রেপ্তার তিনজন আমাদের আক্রমণ করে মারধর করেছেন। তবে মূল হত্যাকারীকে ধরা হয়নি, তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।”

ঘটনাস্থলে উপস্থিত আইইআর-এর আরেক শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম রাফি হত্যাকারীর বর্ণনা দিয়ে বলেন, “যে তিনজনকে ধরা হয়েছে তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তারা মূল হত্যাকারী নন। সাদা জামা কিংবা পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তি সাম্যকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। ওই ব্যক্তির গায়ের রঙ ফর্সা; তাকে দেখতে মোটেও উদ্বাস্তুর মতো নয়।”

একই ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ফারহান শাহরিয়ার চৌধুরী বলেন, “হত্যার দিন রাতে আমাদের ইনিস্টিটিউটের একটি প্রোগ্রাম ছিল। রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত আমরা সাম্য ভাইয়ের সঙ্গেই ছিলাম।”

তার দাবি, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ছুরিকাঘাত এবং সোয়া ১২টার দিকে সাম্যকে মৃত ঘোষণা করা হলেও হত্যাকাণ্ডের ৬ ঘণ্টা পরও ঘটনাস্থল অরক্ষিত ছিল। ঢাবি শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে ঘটনাস্থলটি রক্ষা করে প্রমাণাদি বাঁচানোর চেষ্টা করেন।

তিনি বলেন, “প্রধান আসামিকে ধরতে পারল না, অথচ শাহবাগ থানার তদন্ত টিমকে পুরস্কৃত করা হলো। পুলিশের এই ধরনের প্রহসনের তীব্র নিন্দা জানাই আমরা।”

পুলিশ কী বলছে

ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. মাসুদ আলম বলেন, “ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীদের ধরতে আমরা শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে তল্লাশি অভিযান শুরু করি। পরে শমরিতা হাসপাতাল থেকে একজন ও বিআরবি হাসপাতাল থেকে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করি।”

তিনি বলেন, “গ্রেপ্তার ওই দুজনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ফোন নম্বর ট্র্যাক করে তৃতীয়জনকে ফার্মগেটের রাজাবাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়।” পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ও দোয়েল চত্বরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব?

এদিকে, পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে বিশ্লেষণ করছে বলে জানালেও রমনা কালী মন্দির ও বাংলা একাডেমি গেটের সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন বায়েজিদ।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত পুলিশ বলছে, সিসিটিভি ফুটেজ নাকি তাদের কাছে আছে। অথচ শাহবাগ থানার পুলিশ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান খান আমাকে পার্সোনালি (ব্যক্তিগতভাবে) ডেকে বলেছেন, পুলিশ মন্দিরের গেট ও বাংলা একাডেমি গেটের সিসিটিভি ফুটেজ পায়নি।”

আক্ষেপ করে এই শিক্ষার্থী বলেন, “রমনা কালী মন্দির একটি ধর্মীয় সেনসিটিভ (স্পর্শকাতর) জায়গা। মন্দিরের সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ না পাওয়া ও বাংলা একাডেমির ফুটেজ নষ্ট হওয়ায় ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশাসনের গাফিলতি আছে।”

তিনি বলেন, “তাদের (বায়েজিদ) সঙ্গে কথা হয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজ অবশ্যই আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার পর দু-তিন চলে গেছে। আমরা বসেছিলাম না, কাজ করেছি। ঘটনার ক্লু বের করার চেষ্টা করছি।”

পরে এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মনসুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজ নষ্ট হওয়ার যে দাবি, সে বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে ওসি বলেন, “সিসিটিভি ফুটেজ আমাদের কাছে আছে। আমরা অন্তত ১১টি আলামত জব্দ করেছি। এগুলো নিয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কাজ করছেন।”

বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হত্যার বিচার-

সাম্য হত্যার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে শনিবার (১৭ মে) ঢাবি প্রশাসন ও ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলীর মধ্যে বৈঠক হয়।

বৈঠক শেষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, “অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে কাজ করছে।”

ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে উপাচার্যও সংহতি প্রকাশ করেছেন। ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী বলেন, “অপরাধীদের আগামীকাল (রবিবার) থেকে রিমান্ড শুরু হবে। দ্রুত তদন্ত কাজ শেষ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।”

এছাড়া আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটিত হবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এ হত্যার বিচার কাজ দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন হবে।”

বিষয়টি নিয়ে উপস্থিত এক আনসার সদস্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “উদ্যানের নিরাপত্তা রক্ষায় রাতের শিফটে আমরা মাত্র ৬ জন। এই ছয়জনের পক্ষে এতো বড় উদ্যানে টহল দিয়ে এসব বিষয়ের সমাধান করা কষ্টসাধ্য।”

আলোকিত প্রতিদিন/এপি  

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here