ভয়াবহ ডেঙ্গু আতঙ্কে রাজধানী

0
21
ভয়াবহ ডেঙ্গু আতঙ্কে রাজধানী
ভয়াবহ ডেঙ্গু আতঙ্কে রাজধানী
জাহিদ হাসান হৃদয়:
রাজধানীর ১ কোটির বেশি মানুষ পরিবারের সঙ্গে গ্রামে ঈদ উদ্যাপনে গেছেন। ঈদ শেষে কিছু মানুষ ঢাকায় ফিরলেও এখনো অনেকে আসেননি। এদিকে কয়েক গত দিনের টানা বৃষ্টিতে বাসাবাড়ির আঙিনা, সানসেটের ওপর, বারান্দা বা ছাদে পানি জমে এডিস মশার বংশবিস্তার বেড়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। সঙ্গে বেড়েছে মশার উপদ্রবও। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। নানা কারণেই এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডেঙ্গু সংক্রমণের ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিশেষজ্ঞরা। তাদের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার প্রতি ১৫টি বাড়ির মধ্যে গড়ে সাত থেকে আটটিতেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। যা ব্রুটো লার্ভা ইনডেক্স অনুযায়ী আশঙ্কাজনকভাবে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জানান, ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে তৈরি তাদের কম্পিউটার ভিত্তিক পূর্বাভাস মডেলে দেখা যাচ্ছে, এ বছর ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ ভয়াবহ আকার নিতে পারে। তিনি বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব, রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা একটি ফরকাস্টিং মডেল তৈরি করেছি। এতে দেখা যাচ্ছে, যদি এখনই এডিসের প্রজননস্থল ধ্বংসে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেড়ে যাবে। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে টানা কর্মসূচি পালন করায় বন্ধ হয়ে যায় সংস্থাটির সব ধরনের সেবা কার্যক্রম। বিশেষ করে ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ পুরাই অচল হয়ে পড়ে। টানা ২০ দিন নগর ভবন ও আঞ্চলিক কার্যালয় বন্ধ থাকায় মশার ওষুধ সরবরাহ করতে পারেনি সংস্থাটি। এতে মশককর্মীরা ওষধ স্প্রে করতে পাপ্রণনি। এ ছাড়া ঈদের ছুটিতে ছিলেন মশককর্মীরা। সব মিলিয়ে প্রায় এক মাস ওষুধ স্প্রে করপ্রেণা পারায় মশার উপদ্রুত বেড়ে যায় ভয়াবহভাবে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মশককর্মীরা নিয়মিত ওষুধ স্প্রে করলেও কমেনি মশার উৎপাত। বাসাবাড়ি, দোকানপাট সবখানে মশা। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ উত্তরের বাসিন্দারাও।
এদিকে গত শুক্রবার এইডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে নতুন করে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫৯ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুক্রবার বলেছে, সবশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আর বাকি চারজনের মৃত্যু হয়েছে বরগুনায় বৃহস্পতিবার। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়াল ২৮ জনে। আর আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৫৭০ জন।
বনশ্রী এইচ ব্লকের বাসিন্দা সাদমান আদিল বলেন, বাসার ভিতরে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ আমরা। কয়েল জ্বালিয়ে এবং মশারির ভিতরেও মশার যন্ত্রণায় থাকা যায় না। আর বাইরেও রাস্তায় দাঁড়াতে পারি না। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ আমরা। প্রায় মাসখানেক এ এলাকায় মশার ওষুধ স্প্রে করতে কাউকে দেখিনি। কী করছে সিটি করপোরেশন? এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চাপ বাড়ছে। মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে নতুন রোগী। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম জানান, ঠান্ডা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। ডাক্তার ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন।
কীটতত্ত্ববিদ ও রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মশার ওষুধ এখন ডাবল স্প্রে করলেও তেমন একটা সুফল পাওয়া যাবে না। এখন সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে এডিস মশার জন্মস্থান ধ্বংস করা। একই সঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিহ্নিত করে সেই সব বাসায় অভিযান পরিচালনা করে আশপাশে ওষুধ স্প্রে করা। তাহলে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। যেহেতু এখন পিক সিজন নয়, সে জন্য বাসাবাড়ি পরিষ্কার এবং সচেতনতা মুখ্য বিষয়। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন বলেন, ঈদের আগে ২০ দিনের মতো নগরভবন ও আঞ্চলিক কার্যালয় অবরুদ্ধ থাকায় আমরা মশার ওষুধ সরবরাহ করতে পারিনি। ঈদের আগের বুধবার আন্দোলন শিথিল হওয়ায় ওইদিন ওষুধ সরবরাহ করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঈদের দিনসহ মোট চার দিন মশককর্মীদের ছুটি থাকায় ওষুধ স্প্রে বন্ধ ছিল। তবে এখন থেকে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এখন আমরা ডাবল ওষুধ স্প্রে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি, খুব দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে, মৃত্যুহারও বেশি হওয়ার শঙ্কা : সারা দেশে বেড়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুরোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা। মশা নিধনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারের পাশাপাশি এ বছর মৃত্যুহার আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। জরিপে দেখা যায়, প্রতি ১৫টি বাড়ির মধ্যে সাত থেকে আটটি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা রয়েছে। এ বছর ৫ হাজার ৪০১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ২৩ জন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। আর মে-আগস্ট পর্যন্ত প্রকোপ থাকে সব থেকে বেশি। বর্তমান সময়টা হলো ডেঙ্গুর মৌসুম। এডিস মশার বিস্তার আগে শুধু রাজধানীতে ছিল, এখন তা গ্রামাঞ্চলেও চলে গেছে। এর চিকিৎসা সাধারণত ঢাকাকেন্দ্রিক ও বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো,  এখনই সরকারের উচিত, সব পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত মশা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আইসিইউ সাপোর্ট বিভাগীয় পর্যায়ে থাকতে হবে। নইলে ঢাকায় আনতে আনতে রোগী মারা যাবে। বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু মশা নিধনের দায়িত্ব প্রশাসনের। প্রশাসন ব্যর্থ হলে এডিস মশার প্রকোপ বাড়বে। মানুষ আক্রান্ত হবে, মৃত্যুর হার বেশি হবে। এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, এখন ডেঙ্গুর মৌসুম চলছে। বাসাবাড়ির মালিকদের দায়িত্ব আছে নিজ বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্ব রয়েছে। শুধু সরকারের দিকে চেয়ে থাকা উচিত হবে না। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে দেশে ডেঙ্গু ভয়াবহ মৃত্যু ডেকে আনবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু উপসর্গ হলো প্রচণ্ড জ্বর, গিরায় গিরায় ব্যথা, ব্যাকপেইন, প্রচণ্ড মাথাব্যথা ও র্যাশ দেখা দেওয়া। এসব লক্ষণ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ফুল হাতা শার্ট-প্যান্ট পরিধান করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না।  জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, রাজধানী থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সরকারের প্রশাসন আছে। এই চেইন যদি মশা নিধনে কাজ করে এবং মানুষ নিজেরাও সচেতন হয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের যাতে ঢাকামুখী না হতে হয়, সেজন্য বিভাগীয় পর্যায়ে আইসিইউ নিশ্চিত করতে হবে। যাতে জটিল রোগীদের ঢাকায় আসতে না হয়। জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)-এর কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, মশার চরিত্র আচরণ অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটার কামড়ানোর ধরনও পরিবর্তন হয়েছে। একটা জরিপে দেখা গেছে, ৫০ ভাগ আবর্জনা আর ৫০ ভাগ বাসাবাড়ির স্বচ্ছ পানিতে এই মশার উৎপত্তি হয়। কীটনাশক ব্যবহার করে, এটি সাধারণত মারা যায় না। এটা নিধন করতে হলে ওষুধও পরিবর্তন করতে হবে। শ্যামলী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশ। করোনার চেয়ে ডেঙ্গু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী, স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু কর্নার প্রস্তুত করছে। তবে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল পরিচালক বলেন, করোনা ও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য মহাখালীতে ১ হাজার বেডের ডেডিকেটেড হাসপাতাল রয়েছে। প্রথম ধাপে সেখানে রোগীদের ভর্তি করার পরামর্শ দেন। সেখানে সামাল দিতে না পারলে রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা যেতে পারে।
বরিশাল অফিস জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের দুইটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ছয়টি সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২৪ জন ব্যক্তি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পিরোজপুরের নেছারাবাদ এলাকার বাসিন্দা ইসরাত জাহান মারা গেছেন। বরগুনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চাঁন মিয়া ও গোশাই দাসের মৃত্যু হয়েছে। সিলেট অফিস জানায়, সারা দেশে করোনার সংক্রমণ ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির সংবাদে সিলেট অঞ্চলে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। সিলেট আন্তর্জাতিক ওসমানী বিমানবন্দর, সিলেটের তামাবিলসহ বিভিন্ন ইমিগ্রেশন সেন্টারে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এক দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১০৮ জন, বেশি বরগুনায় :দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ১০৮ জন। এ সময়ে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ১০৮ রোগীর মধ্যে ৭৯ জনই বরগুনা জেলার।
আলোকিত প্রতিদিন/১৫জুন ২০২৫/মওম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here