ইউনূস-তারেক বৈঠক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃযাত্রা!

0
27

মতামত,

ড. এস.এম.শাহান শাহ শাহীন
বিশ্বব্যাপী ড. ইউনূসের যে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে তাঁকে সব সময় পাশে পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারেক রহমান।
সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের সাথে বৈঠক নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক সংবাদ এবং লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনাও হচ্ছে। এমতাবস্থায় কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছি। 
৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই গণতন্ত্রকামী দলগুলো একটি জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে আসছিল। দুঃখজনকভাবে, অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়ে বড় রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপিকে আস্থায় আনতে ব্যর্থ হওয়ায় এক অবিশ্বাস ও দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। লন্ডনে দীর্ঘ ১০ মাস পর অনুষ্ঠিত এই বৈঠক সেই দূরত্বের বরফ গলাতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, যা নির্বাচনের অনিশ্চয়তা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

রাজনীতিতে অনেকটা চমক হিসেবে আসা এই বৈঠক ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে সৃষ্ট টানাপোড়ন অনেকটাই কমিয়েছে। সরকার এবং বিএনপি উভয় পক্ষই বৈঠকটিকে ফলপ্রসূ বলে আখ্যায়িত করেছে। জানা গেছে, উভয় পক্ষ জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার, বিচার এবং জুলাই সনদসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে একমত হয়েছে। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও জনাব তারেক রহমান নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে এসে আগামী বছর রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে একমত পোষণ করেছেন, যা দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে স্বস্তিদায়ক সুবাতাস এনেছে।

দুই-একটি দল নাখোশ হয়ে বলেছেন যে, প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ প্রেস ব্রিফিং করায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা আশা করে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ থেকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করবে। এই তালিকায় রয়েছে জামায়েতে ইসলামী এবং এনসিপি।

তারা বলেছেন, ‘লন্ডনের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, বিচার ও সংস্কার তত গুরুত্ব পায়নি। নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, খেলাফতে মজলিস, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ১২-দলীয় জোটসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এ বৈঠক নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে বিএনপিকে বৃহৎ জন-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে সুতরাং এই বৈঠক নিয়ে হতাশা প্রকাশ না করে গণতান্ত্রিক উত্তরনে অগ্রগতি ভাবতে হবে।

দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির শেষ অবস্থান ছিল নির্বাচন কোনোভাবেই ডিসেম্বরের পরে নেওয়া যাবে না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ ক্ষেত্রে দলের এক সমাবেশে (ঢাকা বিভাগীয় তারুন্যের সমাবেশ) এক ভার্চুয়াল বক্তৃতায়-অনড় অবস্থান ব্যক্ত করেন। রাজনীতির আরেক শক্তি জামায়াতে ইসলামী রমজানের আগে অথবা এপ্রিল মাসেও নির্বাচন হতে পারে বলে মত দেয়। এনসিপি গণহত্যার বিচার ও সংস্কারের পর নির্বাচন হওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। নির্বাচন নিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক পক্ষ গুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এক জটিলতা তৈরী হয়েছিল। পবিত্র ঈদুল আজহার আগের দিন ৬ জুন দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রফেসর ইউনূস আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন। বিএনপি এ ঘোষণায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে। দলটির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। তবে জামায়াতে ইসলামী প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। এনসিপি নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কার দৃশ্যমান করার দাবি পুনরুল্লেখ করে। ফলে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন ঘিরে সৃষ্টি হয় এক অনিশ্চয়তা।

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি রাজনীতির জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করছে অভিজ্ঞ মহল। ড. ইউনুস ও তারেক রহমানের এ সংলাপ গণ অভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে গুরুত্বপূর্ণ এক মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে গণতন্ত্রকামী জনতার বিশ্বাস। প্রধান উপদেষ্টার ভাষনকে কেন্দ্র করে ধোঁয়াশা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটে অনেকটা আকস্মিকভাবেই লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ন অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের এক সপ্তাহের মধ্যে প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের ঠিক আগমুহূর্তে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক এর খবরটি দেশে বিদেশে সবকিছু ছাপিয়ে চলে আসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণায় জানানো হয়, নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় এপ্রিল থেকে এগিয়ে ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে নির্ধারণে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি একমত হয়েছে। তবে বিচার ও সংস্কার বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি একটি পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠকের প্রথমার্ধে আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন করার প্রস্তাব দেন তারেক রহমান। এর জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে রমজান শুরুর আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতামূলক মতৈক্য তৈরী হয়।

দেড় ঘণ্টার এ আলাপকালে তারেক রহমান অধ্যাপক ইউনুসকে একটি কলম ও দুটি বই উপহার দেন যা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ওই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে তারেক রহমান বলেন, তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে একজন নতুন অভিভাবক পেয়েছেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে তিনি তাঁর মা খালেদা জিয়া এবং ড. ইউনুসের পরামর্শ নিয়ে পথ চলবেন বলে উল্লেখ করেন। বিশ্বব্যাপী ড. ইউনূসের যে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে তাঁকে সব সময় পাশে পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারেক রহমান। এ সময় ড. ইউনুস দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারেক রহমানের ভাবনা ও পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

বিএনপির শীর্ষ নেতত্বের চিন্তাভাবনা অত্যন্ত ইতিবাচক। প্রফেসর ইউনূস যদি পরবর্তী সম্ভাবনাময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারকে সহযোগিতা করতে পারেন তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির শক্ত ভিত রচনা হবে। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে যদি আমেরিকা, ইউরোপ, চীন, জাপান, মালয়শিয়া তথা গুরুত্বপূর্ন দেশ গুলোর অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাড়ানো যায়, কম বেশী সবার সাথে বানিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকে তবে বাংলাদেশ হতে পারে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র। যা একটি রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে বহুদুর।

বৈঠকে তারেক রহমান তাঁর মা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সালাম পৌঁছে দেন ড. ইউনুসকে। সালামের জবাব দিয়ে প্রফেসর ইউনুস বলেন, ‘উনি (খালেদা জিয়া) অসাধারণ মানুষ। বৈঠকের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা থাকলেও পরবর্তীতে ড. ইউনূসে ও তারেক রহমান প্রায় এক ঘণ্টা ওয়ান টু ওয়ান একান্তে আলোচনা করেন। বৈঠকের পরে যৌথ বিবৃতি পড়ে শোনান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আলোচনায় উভয় পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেন।

গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, অতীতে যেসব ছোটখাটো কথাবার্তা হয়েছে, সেগুলোকে ভুলে গিয়ে যাতে সামনে জাতীয় ঐক্যকে আরও দৃঢ় করে ফেব্রুয়ারিতে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনে যেতে পারি এবং জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারি, সেদিকে নজর দিতে হবে। আমরা যেন ১৫ বছরের ফ্যাসিস্টদের করা কাঠামোকে নতুন করে একটা গণতান্ত্রিক কাঠামোতে রূপান্তর করতে পারি, তার ওপর গুরুত্ব দেন মির্জা ফখরুল।

পর্যবেক্ষক মহল ও গণতান্ত্রকামী নাগরিকগণ মনে করেন যেসব রাজনৈতিক দল ছাত্র-জনতার সঙ্গে সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটিয়েছে, তাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে ড. ইউনুস ও তারেক রহমানের এ সংলাপ রক্তস্নাত ছাত্র গণ অভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে সফলকাম হবে। একটি অবাধ সুষ্ঠ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যে দিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পূনঃ প্রতিষ্ঠার ভিত রচিত হবে, বৈঠকটি ইতিহাসে স্থান করে নিবে।

লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক

আলোকিত প্রতিদিন/এপি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here